তিনি কারাগারে বা বাইরে যেখানেই থাকুন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলেই ২৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তির পরও সরকার তাঁকে কঠোর নজরদারিতে রেখেছিল। তা ছাড়া বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু তো জাতীয় নেতা। তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক।
অলি আহাদ লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি হইতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন। চিকিৎসার কারণে সরকার তাঁকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেন। প্রহরী পুলিশের ইচ্ছাকৃত নির্লিপ্ততার সুযোগ গ্রহণ করিয়া আমরা তাঁহার সহিত হাসপাতালেই কয়েক দফা দেখা করি। তিনি ও নিরাপত্তা বন্দী মহিউদ্দিন আহমেদ ১৬ ফেব্রুয়ারি হইতে মুক্তির দাবিতে অনশন ধর্মঘট করিবেন, সেই কথা শেখ সাহেবই আমাদিগকে জানাইয়াছিলেন।’ ছাত্রনেতারা গোপনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতেন। তাঁর মুক্তির জন্য রাজনৈতিক নেতারা বিবৃতি দেন। হাসপাতাল থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য চিকিৎসা শেষ না হতেই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়। তখন তিনি ও মহিউদ্দিন আহমেদ চিঠি দিয়ে সরকারকে জানান, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মুক্তি না দিলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁরা অনশন ধর্মঘট শুরু করবেন।
‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ শিরোনামে গ্রন্থে গাজীউল হক লিখেছেন, ‘মুজিব তখন কারাগারে। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মিছিল ধর্মঘট হয়েছিল। মিছিল করে সারা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করেছিল শত সহস্র ছাত্র-জনতা। মিছিল শেষে পরবর্তী ঘোষণার জন্য সবাই বেলতলায় জমা হয়েছে। শামসুল হক চৌধুরী, গোলাম মওলা, আবদুস সামাদ আজাদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু খবর পাঠিয়েছেন। তিনি সমর্থন জানিয়েছেন একুশের দেশব্যাপী হরতালের প্রতি। একটি বাড়তি উপদেশ—মিছিল করে সেদিন আইনসভা ঘেরাও করতে হবে, বাংলা ভাষার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আইনসভার সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে। আরও একটি খবর পাঠিয়েছেন যে তিনি এবং মহিউদ্দিন আহমেদ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে অনশন করবেন। একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল হবে।’
আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে কারাগার থেকে নির্দেশনা দিয়েছেন।
বায়ান্নর আন্দোলনে জেলে বসে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার বিরুদ্ধে গিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের সদস্য ও সমর্থকদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে থাকতে নির্দেশ দেন। তিনিই শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বাংলা ভাষার পক্ষে মত পরিবর্তনে বাধ্য করেন। সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উপদেশে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা আন্দোলন থেকে বিরত থাকতে পারতেন। তাহলে ভাষা আন্দোলনের সাফল্য অনেক কঠিন হয়ে যেত।
আইয়ুব খান বাংলায় রোমান হরফ ব্যবহারের চক্রান্ত করেছিলেন। এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে মুনীর চৌধুরীসহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা যে আন্দোলন গড়ে তোলেন, বঙ্গবন্ধু তার প্রতি প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি ভাষা আন্দোলনে বিভিন্ন সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন। বায়ান্ন সালে জেলে থেকেই ভাষা আন্দোলনের নির্দেশনা দিয়েছেন। কোনো সন্দেহ নেই, বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে ভাষা আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদন; আবদুস সামাদ আজাদ, অলি আহাদ, গাজীউল হকসহ অনেক ছাত্রনেতা ও ভাষাসংগ্রামীর স্মৃতিচারণায়, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও দলিলপত্রে।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির শর্ত যুক্ত থাকাই প্রমাণ করে যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
দেশভাগের যেমন সূচনাপর্ব থেকেই তিনি বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছেন, পরবর্তীকালে আইনসভার সদস্য ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সংবিধানে বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বিধিবদ্ধ করেন। জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলায় প্রথম ভাষণ দেন। বাংলাকে আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদায় উন্নীত করেন। ভাষা আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধুর মধ্যে অন্য রকম চেতনা সৃষ্টি হয়। এখান থেকে তাঁর বৃহত্তর আন্দোলন–সংগ্রামের পথ তৈরি হয়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজনৈতিক মঞ্চে তিনি মহানায়কের ভূমিকায় আসেন।