সেদিন ছিল ১৯৪৮ সাল। ১৬ মার্চ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের আমতলা। সেখানে সাধারণ ছাত্রদের সভা। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হলেন। তখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিলেন নঈমুদ্দীন আহমদ। সভাপতি হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর নাম প্রস্তাব করলেন। সবাই সমর্থন করল। ঢাকা মেডিকেলের বিখ্যাত সেই আমতলায় শুরু হলো সভা। বঙ্গবন্ধুই প্রথম ব্যক্তি, যিনি রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আমতলায় প্রথম সভাপতিত্ব করেন। সবার শেষে বক্তৃতায় তিনি বলেন যে পুলিশ তাঁদের ওপর নির্মম জুলুম করেছে। আর খাজা নাজিমুদ্দিন এর তদন্ত করবেন। আবার তিনি নিজেই প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই তদন্ত তাঁরা মানেন না। ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে নাজিমুদ্দিনের আপস হয়েছে। এ সভায় সেটা অনুমোদন হয়।
বঙ্গবন্ধুসহ ছাত্ররা তদন্তের প্রস্তাব মানেন না। তাঁরা আইনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দিতে গেলেন। তখন আইনসভার কাছে গেলেন। আবার পুলিশের সঙ্গে গন্ডগোল হলো। লাঠিপেটা করল পুলিশ। কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ল। বঙ্গবন্ধুর চোখে লাগল কাঁদানে গ্যাস। চোখ জ্বলছে। চোখ থেকে পানি পড়ছে। কয়েকজন পলাশী ব্যারাকের পুকুরে নিয়ে চোখে পানি দিলেন।
সন্ধ্যার পর ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের সভা। বঙ্গবন্ধু সে সভায় আবার বক্তৃতা করলেন। কয়েক দিন আন্দোলন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হলো। কারণ, দেশভাগের পর এই প্রথম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসবেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না; ফরিদপুর, যশোরে কয়েক শ ছাত্র বন্দী হলেন। রাজশাহী, খুলনা, দিনাজপুরসহ অনেক জায়গায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল। এ আন্দোলনকে বানচাল করতে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ অনেক চেষ্টা করেছিল, পারেনি। ভাষার আন্দোলন শুরু করেছিল ছাত্ররা। কিন্তু এটা শুধু ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; অনেক সাধারণ মানুষও রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পথে নেমেছিল। সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে বিভিন্ন প্রতারণার আশ্রয় নেয়। তারা বলেছিল, কলকাতা থেকে হিন্দু ছাত্ররা এসেছে। এসব ছাত্র পায়জামা পরে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। কিন্তু পরে দেখা গেল, ৭৫ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজনও হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিল না। পূর্ব বাংলার বেশির ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা। যেকোনো বিবেচনায় বাংলাই হওয়া উচিত রাষ্ট্রভাষা। তারপরও বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। মুসলিম লীগ সরকারের যুক্তি হলো, উর্দু ইসলামিক ভাষা। এটা ছিল একটা প্রতারণা। উর্দু কোনো ইসলামিক ভাষা নয়। পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের কোনো অঞ্চলের ভাষা উর্দু নয়। প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের নাগরিকেরা তাদের নিজস্ব ভাষা পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু ও বালুচ ভাষায় কথা বলে। পাকিস্তানি শাসকেরা ছিল মিথ্যুক ও প্রতারক। ইসলামের কথা বলে পূর্ব বাংলার ধর্মভীরু মানুষকে ধোঁকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি।