বইমেলা উপলক্ষে আশফাকুজ্জামানের ধারাবাহিক
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সাহসী উচ্চারণ, অন্যদের নীরবতা
পাকিস্তান একটি বহুভাষী রাষ্ট্র। শাসকগোষ্ঠী চায় সব ভাষার মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে। তাই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র করে। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের বড় অংশ ছিল উত্তর ভারতের উর্দুভাষী। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে পাকিস্তানের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের ভাষা ছিল উর্দু। এদের মোহাজের বলা হতো। উর্দুতে ‘মোহাজের’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘অভিবাসী’। যাঁরা ভারত থেকে পাকিস্তানে অভিবাসী হয়েছেন, তাঁদের মোহাজের বলা হয়। জিন্নাহ ও তাঁর উত্তরসূরি লিয়াকত আলীর মন্ত্রিসভাকে বলা হতো ‘মোহাজের মন্ত্রিসভা’। এরা প্রায় কেউ পাকিস্তানের ছিলেন না। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এই এক দশকের বেশি সময়ে পাকিস্তানে মোট ২৭ জন গভর্নর জেনারেল/প্রেসিডেন্ট/প্রধানমন্ত্রী/প্রাদেশিক গভর্নর ও মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ১৮ জন ছিলেন মোহাজের। এদের আবার প্রায় সবার ভাষা ছিল উর্দু। এ জন্য নিজেদের স্বার্থে প্রথম থেকেই তাঁরা উর্দু ভাষার পক্ষে ছিলেন। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও ছিলেন উর্দুভাষী। তাঁরা নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখার ভাষা বেছে নেন।
সে সময় দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দুর চর্চা ছিল। তাই সাধারণ মানুষ এর প্রতিবাদ করেননি। উপরন্ত তাঁরা ছিল দুর্বল। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন প্রভাবশালী। তাঁরা প্রতিবাদ করেননি। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতারা সুযোগ-সুবিধা হারানোর ভয়ে উর্দুর বিরুদ্ধে কথা বলেননি। তা ছাড়া পূর্ব বাংলার প্রায় অধিকাংশ মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন তোষামোদি প্রকৃতির। কিন্তু পূর্ব বাংলার ছাত্ররা, রাজনীতিবিদ, সাধারণ মানুষ প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।
১৯৪৮ সাল। ৮ ফেব্রুয়ারি। করাচিতে সংবিধান সভার বৈঠক। এ বৈঠকে রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি আলোচনায় হয়। পাকিস্তানের মুসলিম লীগের নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন।
কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত আইনসভার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ওই সভায় ছিলেন। একমাত্র তিনিই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। কারণ, পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা। সে সভায় মোট ৭৯ জন নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। এর মধ্যে পূর্ব বাংলার সদস্য ছিলেন ৪৪ জন। এদের মধ্যে মাত্র তিনজন জোরালোভাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সমর্থন করেন। তাঁরা হলেন প্রেম হরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত ও শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এ জন্য লিয়াকত আলী খান তাঁদের ধিক্কার দেন। তিনি ও রাজা গজনফর আলী খান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। তাঁরা দুজন ছিলেন মোহাজের। ভারতের পাঞ্জাবের নাগরিক। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন যে পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে মুসলিমদের ভাষা হবে উর্দু। লিয়াকত আলী খানের কথার প্রতিবাদ করেন শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, পরিষদ নেতার মুখে এ কথা শুনে তিনি হতাশ হয়েছেন। সব সময় তাঁর ধারণা ছিল যে পাকিস্তান একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রে মুসলিম-অমুসলিমদের সমান অধিকার।
কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, পূর্ব বাংলার কোনো মুসলিম লীগ সদস্য এর প্রতিবাদ করেননি। সেদিন পূর্ব বংলার অন্য সদস্যরা নীরব ছিলেন। তাঁরা বাংলা ভাষার পক্ষে সমর্থন দিতে পারতেন। তাহলে হয়তো বায়ান্নতে রক্ত দিতে হতো না। ব্যাপকভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের কোনো মুসলিম সদস্য বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার কথা বললেন না। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি খাজা নাজিমউদ্দিন ও তমিজউদ্দিন খান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করেন।
অথচ খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন নওয়াব পরিবারের সদস্য। তমিউজদ্দিনের বাড়ি ছিল ফরিদপুরে। তিনি অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রীপরিষদের সদস্য ছিলেন। পাকিস্তানের গণপরিষদের স্পিকার ছিলেন। নাজিমউদ্দিন বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চান। শুরু হলো বাংলাকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান প্রস্তাবটা কণ্ঠভোটে দিলেন। মোট সদস্য ছিলেন ৭৯ জন। পূর্ব বাংলার ৪০ সদস্য সমর্থন দিলেও পাস হয়ে যেত। কিন্তু সেদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল।