পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই বাংলা-উর্দু বিতর্ক

ভাষা আন্দোলনছবি: সংগৃহীত

১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। তখন মুসলিম লীগের অধিবেশনেও ভাষার প্রশ্ন আসে। কিন্তু বিষয়টি তেমন প্রকট হয়নি। ১৯১৩ সালে জিন্নাহ মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৩৫ সালে তিনি এ দলের সভাপতি হন। ১৯৩৭ সালে উর্দুকে দলের দাপ্তরিক ভাষা করার কথা বলেন। কিন্তু ফজলুল হক এর বিরোধিতা করেন। ফলে জিন্নাহর এই উদ্যোগ সফল হয়নি। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব হয়। এ প্রস্তাবের আগে আবার ভাষার বিতর্ক দেখা দেয়। কংগ্রেস নেতারা হিন্দিকে আর মুসলিম নেতারা উর্দুকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। খুব মৃদু হলেও কেউ কেউ বাংলার কথাও বলেন।

এদিকে প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় পাকিস্তান রাষ্ট্র। তখন ভাষার বিতর্ক নতুন মোড় নেয়। সে সময় ভারতের উত্তর প্রদেশের এক নামকরা মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন। তাঁর নাম চৌধুরী খালিকুজ্জামান। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। এই উত্তর প্রদেশে রয়েছে আলিগড় নামে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজ আমলে একসময় এটি সারা ভারতের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছিল। সে সময় উর্দু ভাষার অনেক বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ, কবি ও লেখক এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ। তিনি এক বক্তৃতায় উর্দুকে ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবীরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাঁরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যুক্তি দেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররাসহ শিক্ষিত সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পত্র-পত্রিকায় লেখেন। এ সময় পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। জুলাই মাসে গঠিত হয় ‘গণআজাদী লীগ’। এসব সংগঠন রাষ্ট্র ভাষা বাংলার পক্ষে ভূমিকা রাখে।

আরও পড়ুন

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট জন্ম হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের। তারপর ভাষা বিতর্ক অন্যতম ইস্যু হিসেবে প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন আবুল কাশেম। তিনি ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি ইসলামি সাংস্কৃতিক সংগঠন করেন। এ সংগঠন বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে কাজ করে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবী সমাজ, সাংবাদিক সংঘ স্মারকলিপি দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। পূর্ব বাংলার মানুষের দাবি উপেক্ষা করা হয়।

ডিসেম্বরের প্রথম দিকে করাচিতে একটি শিক্ষা সম্মেলন হয়। সেখানে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হয়। সরকারি কোনো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। ঢাকার বাইরেও এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ৬ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রতিবাদ মিছিল হয়। মিছিল শেষে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের দাবি-দাওয়া পেশ করেন। কিন্তু সরকারের ষড়যন্ত্রে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ১২ ডিসেম্বর এমন এক সংঘর্ষে বাঙালি ছাত্ররা আহত হন। এই ঘটনার প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর সচিবালয়ের কর্মচারীরা ধর্মঘট পালন করেন। সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৫ দিন সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।