জিন্নাহকে ব্যবহারের ষড়যন্ত্র

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহছবি: সংগৃহীত

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একধরনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তাঁর ন্যায়সংগত কথা প্রায় সবাই মানত। মুসলিম লীগ সরকার মনে করেছিল, জিন্নাহকে দিয়ে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বলাতে পারলে কেউ কথা বলবে না। শেষ ট্রাম্পকার্ড হিসেবে তাঁকে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ কী চায়, জনগণ কোন পথে—এ বিষয়ে তাঁকে কিছু বলেনি।

আরও পড়ুন

পূর্ব বাংলা ও পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলে। সে সময় সামান্য কিছু মানুষ ছাড়া পূর্ব বাংলার প্রায় সবাই বাংলায় কথা বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা নিজ দেশের ভাষায় কথা বলে। আরবের লোকেরা আরবি, পারস্যের লোকেরা ফারসি, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষায় কথা বলে।

আরও পড়ুন

অথচ মুসলিম লীগের জ্ঞানপাপীরা ধোঁকা দিতে চেষ্টা করল। তারা বলল যে উর্দু ইসলামিক ভাষা। তাই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কিন্তু সে চেষ্টা তাদের সফল হয়নি। যেকোনো জাতি তাদের মায়ের ভাষাকে ভালোবাসে। কেউ এ ভাষার অপমান সহ্য করতে পারে না।

আরও পড়ুন

১৯৪৮ সাল। ১৯ মার্চ। জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। তিনি শুনলেন মুসলিম লীগের পরামর্শ। তারপর উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তখন ঘোড়া দৌড়াত। এর নাম ছিল রেসকোর্স ময়দান। ২১ মার্চ এই ময়দানে জিন্নাহর গণসংবর্ধনা হয়। সেদিন বিশাল জনসভা হয়। এ সভায় জিন্নাহ বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ বঙ্গবন্ধু প্রায় কয়েক শ ছাত্র নিয়ে সেই সভায় ছিলেন। সবাই চিৎকার করে জানিয়ে দিলেন, ‘উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা মানি না।’ তারপর ২৪ মার্চ কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব হলো। এখানেও ভাষণের সময় জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। এবারও ছাত্ররা হলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ‘না’, ‘না’ ধ্বনিতে চিৎকার করে উঠলেন। জিন্নাহর কণ্ঠ স্তিমিত হয়ে গেল। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে এত মানুষ তাঁর মুখের ওপর না করবে। জিন্নাহর সামনে না বলার পর তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন। তিনি যত দিন বেঁচে ছিলেন, আর কোনো দিন বলেননি যে উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। শেষ পর্যন্ত তারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ব্যবহার করেও ব্যর্থ হলো।

আরও পড়ুন

জিন্নাহ চলে গেলেন। তারপর ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হলো। সে সভায় এক ছাত্র বললেন, ‘জিন্নাহ যা বলবেন, তা–ই আমাদের মানতে হবে। তিনি যখন উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন, তখন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে।’ তখন সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদ করে বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, ‘কোনো নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাঁকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরুর দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যা–ই হোক না কেন। আমরা প্রস্তুত আছি।’

আরও পড়ুন

এ বক্তৃতার পর ছাত্ররা বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করল। পূর্ব বাংলার ছাত্র-যুবকেরা একত্র হলো। তারা শোভাযাত্রা করল। সভা করল। ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হলো। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই দৃশ্যপট বদলে গেল। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রায় কোনো সমর্থকই রইল না। শুধু কয়েকজন নেতা রইল। তারা মন্ত্রীদের বাড়ি যাওয়া-আসা করত। এ ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ রইল না।