ভাষা আন্দোলনের পুস্তিকা প্রকাশ, রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন, বিভিন্ন জেলায় সফর, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হরতালের কর্মসূচি প্রণয়ন, হরতাল বাস্তবায়নে ১০ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে পরিকল্পনা গ্রহণ, ১১ মার্চ পিকেটিংয়ে নেতৃত্ব, পুলিশি হামলার শিকার ও ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রতিবাদ দিবস ১১ মার্চের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রেপ্তার, ১৫ মার্চ মুক্তিলাভের সঙ্গে সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দিনের স্বাক্ষর করা আট দফা চুক্তি প্রত্যাখ্যান, আবার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া, ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে সভাপতিত্ব, মিছিল নিয়ে পরিষদ ভবন ঘেরাও, ১৭ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলের সভায় বক্তৃতা, জিন্নাহর রেসকোর্স ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ—এসব ঘটনাই বলে দেয় যে আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর কী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কী অপরিসীম দরদ ও ভালোবাসা ছিল ভাষার প্রতি। আর কত গভীরভাবে তিনি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার ইতিহাসে আরও একটি ঐতিহাসিক দিন। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও উদ্যোগে এদিন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় এ সংগঠনের ১০ দফা করণীয় ঠিক করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ সংগঠন রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন করেছে। বিশেষ করে ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তারা ঝুঁকি নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করেছে। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে—বঙ্গবন্ধুকে জেলে যেতে হয়। রাজনৈতিক কারণে এটিই ছিল তাঁর প্রথম জেল। এরপর পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে বারবার তাঁকে বন্দী হতে হয়।
সময় গড়িয়ে যায়। আসে ১৯৪৯ সাল। এ বছরের ১৪ অক্টোবর ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে এক সভা হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেন। সভা শেষে ভুখা মিছিল হয়। এ মিছিল থেকে মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এবার তিনি প্রায় দুই বছর পাঁচ মাস কারাগারে ছিলেন। অবশেষে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি পান। কিন্তু কারাগারে থেকেও তিনি নানাভাবে নেতা-কর্মীদের ভাষা আন্দোলনের নির্দেশনা দিয়েছেন।
ভাষাসংগ্রামী ও ছাত্রনেতা আবদুস সামাদ আজাদ বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনের নির্দেশনা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন এবং সেই সময় তিনি একাধারে প্রায় আড়াই বছর কারাবরণ করেন। প্রতি ১৫ দিন অন্তর তাঁকে (বঙ্গবন্ধু) আদালতে আনা হতো এবং সেই সুবাদে আমিসহ অনেকেই বিভিন্নভাবে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। আমি ও তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজসহ আমরা অনেকেই বিভিন্ন সময় গোপনে তাঁর সঙ্গে হাসপাতালে সাক্ষাৎ করতাম এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতাম।’
২৬ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্ত হয়েই বঙ্গবন্ধু দৈনিক আজাদ–এ লিখলেন, ‘আপনারা সংঘবদ্ধ হোন। মুসলিম লীগের মুখোশ খুলে ফেলুন। এই মুসলিম লীগের অত্যাচারে মাওলানা ভাসানী, আবুল হাশেম ও অন্য কর্মীরা আজ কারাগারে। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না। বাঁচতে চাই। লেখাপড়া করতে চাই। ভাষা চাই।’ তিনি রাষ্ট্রভাষার ওপর গণভোট দাবি করে বলেন, ‘মুসলিম লীগ সরকার আর মর্নিং নিউজ গোষ্ঠী ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলা ভাষা চায়।’ উর্দুর পক্ষে কথা বলার জন্য তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীরও কঠোর সমালোচনা করেন।
‘৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময়টাতে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু চিরকুটের মাধ্যমে ছাত্রনেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদসহ অনেক ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাঁদের আন্দোলনের নির্দেশনা দিয়েছেন। ছাত্রনেতারা আন্দোলনকে সফল করে তুলেছেন।