সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকানন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক, ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
তুমি আজ জাগো, তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
—আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
তখনও পাকিস্তান হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আলোচনা চলছে। সে সময় বাংলা ভাষাকে আসন্ন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালের ৭ জুলাই কলকাতার ইত্তেহাদ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর এই দাবি প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এরও অনেক আগে সেটা ছিল ১৯২১ সাল। তখন নওয়াব আলী চৌধুরী ছিলেন বাংলার অন্যতম শিক্ষাবিদ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার লিখিত প্রস্তাব তিনিই প্রথম দেন। তাঁর কথা ছিল ভারতের রাষ্ট্রভাষা যেটা হবে হোক। কিন্তু বাংলা ভাষাকে করতে হবে বাংলার রাষ্ট্রভাষা। এরপর শুরু হয় উর্দু আর বাংলার বিতর্ক।
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে কবিগুরু তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।’ বাঙালি যেন তার সব বাধা অতিক্রমের জন্য পেয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুকে। পূর্ব বাংলায় সাতচল্লিশে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর সংগ্রাম। তারপর এই আন্দোলনের পুরোটা সময়েই ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও বাংলাদেশ—প্রতিটির সঙ্গে রয়েছে তাঁর নাড়ির টান। বঙ্গবন্ধু ছাড়া এর যেকোনো আলোচনাই সম্পূর্ণ হয় না।
দেশভাগের আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে পূর্ব বাংলার জন্য ভালো কিছু হচ্ছে না। তাই বাংলার মানুষ তাঁদের অধিকার রক্ষায় সচেতন হয়। তখন বঙ্গবন্ধু, কাজী ইদ্রিস, শহীদুল্লা কায়সার, রাজশাহীর আতাউর রহমানসহ অনেকেই কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে এক বৈঠকের আয়োজন করেন। পূর্ববঙ্গের যুবসমাজের করণীয় ঠিক করা ছিল এ বৈঠকের উদ্দেশ্য।
এ সময় আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ এক নিবন্ধ লেখেন। সে নিবন্ধে তিনি উর্দুকে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। তত দিনে বাঙালির আত্ম-অন্বেষণ শুরু হয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি দৈনিক আজাদে লেখেন, প্রস্তাবিত পাকিস্তানের যদি একটি রাষ্ট্রভাষা হয়, তবে গণতন্ত্রসম্মতভাবে শতকরা ৫৬ জনের ভাষা বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। রাষ্ট্রভাষা যদি একাধিক হয়, কেবল তখনই উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
তারপর ১৪ আগস্ট স্বাধীন পাকিস্তানের জন্ম হয়। নেতৃবৃন্দ ঢাকায় আসেন। তাঁরা ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সাতচল্লিশের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন হয়।
নাজিমুদ্দীনের সরকার এ সম্মেলনে বাধা সৃষ্টি করে। কোথাও জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন খানসাহেব আবুল হাসনাত। তাঁর বাড়িতে সম্মেলন হয়। দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় এটি ছিল প্রগতিশীল নেতাদের সম্মেলন।