পুলিশি জুলুম চলবে না, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই

বাংলা ভাষা আমাদের গৌরবছবি: আশরাফুল আলম

ঘটনার শুরুটা হয়েছিল ১৩ মার্চ। সেদিন সন্ধ্যায় কারাগারে একটা গোলমাল হয়। একজন অবাঙালি জমাদার প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর ওয়ার্ডে এসে গুনে দেখেন, সব ঠিক আছে কি না। সেদিন আর হিসাব মেলে না। কিছু কম বয়সী ছাত্র ছিল। তারা এদিকে-ওদিক চলে যেত। বঙ্গবন্ধু সবাইকে বুঝিয়ে এক করতেন। পরে অবশ্য হিসাব মিলেছিল। কিন্তু জমাদার বাইরে গিয়ে হঠাৎ পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে দেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

এর অর্থ চরম বিপদ। এ সময় আইন বলে কিছু থাকে না। সিপাহিরা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগীরা যে ওয়ার্ডে ছিলেন, সেখানে ডিউটিতে ছিলেন একজন বাঙালি সিপাহি। তিনি তালা বন্ধ করে নিচে গেলেন। জমাদার তালা খুলে সবাইকে মারতে চেয়েছিলেন। তারপর জেলার, ডেপুটি জেলার ও বিল নামে একজন জেল সুপারিনটেনডেন্ট এলেন। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন, একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। সবার মনেই অজানা শঙ্কা।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

অল্প বয়সী ছাত্ররা দুষ্টুমি করত ঠিকই, কিন্তু তাদের ছিল দারুণ মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম। এদের মধ্যে একজন ছিল নয়-দশ বছরের ছেলে। একদিন তার বাবা এসে বললেন, তাকে আজই ছাড়িয়ে নেবেন। কিন্তু সে তার বাবাকে বলেছিল, সব ছাত্রকে না ছাড়লে সে জেল থেকে যাবে না। এ কথা শুনে সবাই তার নামে জেলের মধ্যে জিন্দাবাদ দিয়েছিল।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

এই ছেলের কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন। যাঁরা জেলে ছিলেন, কারও মনোবল নষ্ট হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মনে পড়ে যায় ১৯৫০ সালের একটি ঘটনা। তখন রাজশাহী জেলের একটা ওয়ার্ডের নাম ছিল খাপড়া ওয়ার্ড। এই বিল সেদিন খাপড়া ওয়ার্ডের ৪০ জন রাজবন্দীকে একটি কক্ষে বন্ধী রাখে। তারপর তাদের ওপর গুলি চালায়। সেটা ছিল ২৪ এপ্রিল। গুলিতে ৭ জন দেশপ্রেমিক নিহত হয়। অন্যরা মারাত্মক আহত হয়। তাই সেদিন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোদ্ধাদের বেঁচে যাওয়া ছিল অনেক বড় সৌভাগ্য। এই বিল তাঁদের মেরেও ফেলতে পারতেন।

আরও পড়ুন

১১ মার্চের হরতালে দানা বেঁধে উঠল আন্দোলন। প্রায় রোজই শোভাযাত্রা হয়। আওয়ামী লীগের কর্মী ওয়াদুদ ও বখতিয়ারকে ভীষণভাবে মারা হয়েছে। এ জন্য তাঁদের হাসপাতালে রাখা হলো। এ ঘটনায় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী, ডা. মালেক, সবুর খান, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুনসহ অনেকে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন। নিজ দলের মানুষও প্রতিবাদ করলেন। এতে নাজিমুদ্দিন কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেলেন। এভাবে চললে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। তিনি কোনো উপায় দেখলেন না। সবশেষে ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি হলেন।

আরও পড়ুন

আলোচনা হলো। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে ছিলেন জনাব কামরুদ্দীন আহমদ। তিনি জেলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সব জানালেন। নাজিমুদ্দিন বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছেন। পূর্ব বাংলার অফিশিয়াল ভাষা হবে বাংলা। কেন্দ্রে বাংলা হবে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। মামলা তুলে নেবেন। বন্দীদের মুক্তি দেবেন। পুলিশের জুলুম তিনি নিজেই তদন্ত করবেন। এই প্রথম স্বৈরশাসকেরা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে নতি স্বীকার করল। কিন্তু তারপরও বঙ্গবন্ধু ভাবলেন, এদের কোনো বিশ্বাস নেই। নাজিমুদ্দিন নিজে হোম মিনিস্টার। আবার তিনিই তদন্ত করবেন।

বঙ্গবন্ধু তখন ছিলেন ঢাকা নাজিমুদ্দিন রোডের তিনতলা জেলের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। জেলখানার দেয়ালের ঠিক পাশেই ছিল আনোয়ারা বেগম মুসলিম গার্লস হাইস্কুল। স্কুলের মেয়েরা প্রতিদিন সকাল ১০টায় ছাদে উঠত। বিকেল পর্যন্ত স্লোগান দিত। স্লোগানের ভাষা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ‘বন্দী ভাইদের মুক্তি চাই।’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি। এসব দেখে বঙ্গবন্ধু একদিন শামসুল হককে বললেন, ‘হক সাহেব, ওই দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।’ হক সাহেব জবাবে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ মুজিব। ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুসহ সব ছাত্রকে মুক্তি দেওয়া হলো। জেলগেট থেকে শোভাযাত্রা করে সবাইকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নেওয়া হলো।