ব্রিটিশ আমলে নির্মিত একটি ভবন রয়েছে বাংলা একাডেমিতে। এটি বর্ধমান হাউস নামে পরিচিত। সাতচল্লিশে দেশভাগ হলো। তারপর বর্ধমান হাউস হলো পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকারি বাসভবন। ১৯৪৭ সাল। ৫ ডিসেম্বর। এ ভবনে এক জরুরি বৈঠক হয়। এটি ছিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা কী হবে, সেটা ছিল বৈঠকের মূল আলোচনা। তখন বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক ও ছাত্ররা এক হন। সবাই মিছিল করে বর্ধমান হাউসের দিকে যান। মিছিলের স্লোগান ছিল—‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে এ স্লোগান উচ্চারণ করেন। তিনিসহ কয়েকজন এ মিছিলে নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু তখন গণতান্ত্রিক যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য।
পাকিস্তানের শাসকেরা আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র করে। এতে ছাত্রসমাজ ক্ষুব্ধ হয়। সেটা ছিল ১৯৪৭ সাল। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ। তখন পূর্ববঙ্গের ১৪ জন প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠক এক হয়। তাঁরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিসহ ২১ দফা সংবলিত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। পুস্তিকার ৬ নম্বর দফা ছিল রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। এই পুস্তিকা রচনায় বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। এর ১৪ জন স্বাক্ষরদাতার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ইশতেহারটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। নাম ছিল রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার—ঐতিহাসিক দলিল। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এই পুস্তিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠক। এ বৈঠকে রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি আলোচনায় এলো। পাকিস্তানের মুসলিম লীগের নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বললেন। কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত আইনসভার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ওই সভায় ছিলেন। একমাত্র তিনিই বলেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। কারণ, পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা।
সে সভায় মোট সদস্য ছিল ৭৯ জন। এর মধ্যে পূর্ব বাংলার সদস্য ছিল ৪৪ জন। তাঁদের মধ্যে মাত্র তিনজন জোরালোভাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সমর্থন করলেন। তাঁরা হলেন প্রেমহরি বর্মণ, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত ও শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এ জন্য লিয়াকত আলী খান তাঁকে প্রকাশ্যে ধিক্কার দেন। তিনি ও রাজা গজনফর আলী খান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন যে পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে মুসলিমদের ভাষা হবে উর্দু। লিয়াকত আলী খানের এ কথার প্রতিবাদে শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বললেন যে পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, পরিষদ নেতার মুখে এ কথা শুনে তিনি খুব দুঃখ পেয়েছেন। সব সময় তাঁর ধারণা ছিল পাকিস্তান একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র মুসলিম-অমুসলিমদের সমান অধিকার।
কিন্তু খুবই অবাক করার বিষয় হলো, পূর্ব বাংলার কোনো মুসলিম লীগ সদস্য এর প্রতিবাদ করেননি। সেদিন পূর্ব বাংলার সব নির্বাচিত সদস্য যদি রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে সমর্থন করতেন, তাহলে হয়তো বায়ান্নতে রক্ত দিতে হতো না। ব্যাপকভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের কোনো মুসলিম সদস্য বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার কথা বললেন না।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি খাজা নাজিমুদ্দীন ও তমিজউদ্দিন খান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করেন। নাজিমুদ্দীন বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চায়। শুরু হলো বাংলাকে বাদ দেওয়ার কঠিন ষড়যন্ত্র।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান প্রস্তাবটা কণ্ঠভোটে দিলেন। মোট সদস্য ছিলেন ৭৯ জন। পূর্ব বাংলার ৪০ জন সদস্য সমর্থন দিলেও পাস হয়ে যেত। কিন্তু সেদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল।