বুক অ্যান্ড ফেয়ার। ছোট্ট দুটো শব্দ। এ দুটো শব্দই একদিন ভীষণভাবে চমকে দিয়েছিল একজনকে। আর এই মানুষটি ছিলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদদীন। সে–ও অনেক দিন আগের কথা। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের গোড়ার দিকের ঘটনা। তখন তিনি বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেন। সে সময় একাডেমি অনেক বিদেশি বই সংগ্রহ করত। এর মধ্যে একটি বই ছিল একেবারে অন্য রকম। বইটির নাম ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড অব বুকস। তিনি মুগ্ধ হয়ে বইটি পড়তে থাকেন। হঠাৎ দুটি শব্দে তাঁর চোখ আটকে যায়। ‘বুক ও ফেয়ার’। মানে! বইমেলা। দারুণ তো! বৈশাখী মেলা। লালন মেলা। বাউল মেলা, আরও কত মেলা আছে। বইমেলা নামে কিছু হতে পারে? এটা তিনি আগে কখনো ভাবেননি।
এ সময় তিনি ইউনিসেফের একটি বিশেষ প্রকল্পে যুক্ত হন। এ প্রকল্প তাঁর বইমেলার ভাবনাকে আরও উসকে দেয়। এটি ছিল শিশু–কিশোর গ্রন্থমেলা উন্নয়ন প্রকল্প। শিশু–কিশোরদের জন্য এ প্রকল্পে বইয়ের সংগ্রহ হয়। এসব বই নিয়ে ১৯৬৫ সালে তিনি একটি শিশু গ্রন্থমেলা করেন।
সরদার জয়েনউদদীন তৃপ্ত হতে পারেননি। এ জন্য ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে তিনি বড় পরিসরে একটি বইমেলার আয়োজন করেন। সবার আনন্দের জন্য এখানে একটি মজার বিষয় উপস্থাপন করেন। তিনি মেলায় একটি গরু বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করেন। গরুটির গায়ে লেখা ছিল, ‘আমি বই পড়ি না।’ সরদার জয়েনউদদীনের এই কৌতুক সবাইকে যথেষ্ট হাসির খোরাক দিয়েছিল। অনেককে বই পড়ার প্রতিও আগ্রহী করে তোলে।
এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। সরদার জয়েনউদদীনের ভাবনার যেন শেষ নেই। ১৯৭২ সালকে ইউনেসকো ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ ঘোষণা করে। সরদার জয়েনউদদীনও ওই বছরই গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হন। আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষকে কেন্দ্র করে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে তিনি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা।
তবে ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমির বইমেলা হয়নি। ১৯৭৪ সালে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন। এ উপলক্ষে নিজামী, চিত্তবাবু, বর্ণমিছিলসহ কয়েকজন প্রকাশক কিছু বই নিয়ে একাডেমিতে আসেন। তাঁরা বই নিয়ে একাডেমির পূর্ব দিকের দেয়াল ঘেঁষে বসে যান। ক্ষুদ্র পরিসরে এটাই ছিল বাংলা একাডেমির বইমেলা।
তবে ১৯৮৩ সালে বইমেলার ধারণার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। কিন্তু এরশাদ শাসনের বিরুদ্ধে সে বছর ছাত্ররা মিছিল করে। শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের উত্তাল মিছিল। মিছিলে ট্রাক তুলে দিয়ে দুজন শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ জন্য ১৯৮৩ সালে আর বইমেলা হয়নি।
পরিপূর্ণভাবে অমর একুশে বইমেলার শুরু হয় ১৯৮৪ সাল থেকে। তারপর প্রতিবছর এর আয়তন ও স্টলের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এভাবে বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে বাংলা একাডেমির বইমেলা সম্প্রসারিত হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও।
শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে কবি, সাহিত্যিক, লেখক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার এক অর্থে যাঁরা বই প্রকাশ করতে চান, সবাই যেন মেলাকে ঘিরে বই প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এটা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়, বইমেলার জন্যই বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্প সমৃদ্ধ হয়েছে। এক মাস ধরে এই মেলা চলতে থাকে। পৃথিবীতে এত দীর্ঘ সময় ধরে আর কোনো বইমেলা চলে বলে জানা নেই। অমর একুশে বইমেলার প্রতি মানুষের প্রবল আগ্রহ। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকেও বইপ্রেমীরা একুশের বইমেলায় আসেন।