বইমেলা উপলক্ষে আশফাকুজ্জামানের ধারাবাহিক
পূর্ব পাকিস্তান কর্মিসম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে
১৯৪৭ সাল। ৭ সেপ্টেম্বর। পূর্ব বাংলার ইতিহাসে এ দিনটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এদিন ‘পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। যুবলীগ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ছাড়াও সেদিন যাঁরা এ উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা হলেন শামসুল হক, তাসাদ্দুক আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, গাজীউল হক, আখলাকুর রহমান এবং রাজশাহী ও বগুড়ার আতাউর রহমান। এ সম্মেলনে কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল ভাষার প্রস্তাব।
সেদিনের তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে প্রস্তাবগুলো উত্থাপন করেন। রাষ্ট্রভাষা–সম্পর্কিত প্রস্তাবে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মিসম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন–আদালতের ভাষা করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে, এ সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছাড়িয়া দেওয়া এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হোক।’ এভাবেই সেদিন পূর্ব বাংলায় বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে প্রথম ভাষার প্রস্তাব উচ্চারিত হয়।
প্রমথ চৌধুরী, মুহম্মদ এনামুল হক, মুজফ্ফর আহমদসহ অনেক লেখক, গবেষক রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি করতে থাকেন। শুধু লেখক ও গবেষক নন, গণ-আজাদী লীগ, তমদ্দুন মজলিস, গণতান্ত্রিক যুবলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ছাত্রসংগঠনও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তুলতে থাকে। পাকিস্তান সরকার বলে যে ভারত পাকিস্তানের ১ নম্বর শত্রু। এমনকি বাঙালিরা যে ভাষায় কথা বলে, তা হিন্দুদের ভাষা। মুসলমানের ভাষা হচ্ছে উর্দু। তাই হিন্দুদের ভাষা বাংলা বাদ দিয়ে মুসলমানদের ভাষা উর্দুতে কথা বলতে হবে। তাদের এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হলো খাজা নাজিমুদ্দীনসহ কিছু বিশ্বাসঘাতক বাঙালি।
এসবের প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ শুরু করে স্বাক্ষর অভিযান। কয়েক হাজার মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। স্বাক্ষর গ্রহণ কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৪৭ সালের কর্মী সম্মেলনে যে ভাষার প্রস্তাব গৃহীত হয়, ১৯৪৮ সালের শুরুতে সেটা বাংলার ছাত্রসমাজের মুখে উচ্চারিত হতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই যে বঙ্গবন্ধু সরাসরি যুক্ত ছিলেন ও নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদন, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, বিভিন্ন পত্রিকার লেখা, ভাষা আন্দোলনের নানান দলিলপত্র, ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিচারণাসহ বিভিন্ন উৎস থেকে।
ভাষা আন্দোলনের শুরুতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা। এর প্রমাণ রয়েছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে, He took very active part in the agitation for adopting Bengali as the State language of Pakistan and made propaganda at Dacca for general strike on 11.3.48 on this issue. On 11.3.48 the subject was arrested for violating orders under section 144 Cr. P. C. (Secret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Volume-1(1948-19750), P. 319
১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত যখনই বঙ্গবন্ধু জেলের বাইরে ছিলেন, তখনই ভাষা আন্দোলনের সব কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন ও নেতৃত্ব দেন।