বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা-২

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বদেশের মাটিতে ফিরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫)।
ছবি: সংগৃহীত

লন্ডনে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর প্রথম কর্মদিবস

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। লন্ডনের ক্লারিজেস হোটেল। এখানেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু প্রথম কার্যদিবস শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতির মর্যাদা দিয়েছে। তাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে গ্রহণ করেছে। বঙ্গবন্ধু ব্রিটেনে ৮ জানুয়ারির দিনটি সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যয় করেন। তাই এই দিন ছিল তাঁর প্রথম কর্মদিবস।

এটা ছিল প্রায় কয়েক ঘণ্টার জার্নি। ৮ জানুয়ারি। বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ১২টা। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি তখন লন্ডনের আকাশে। কিছুক্ষণের মধ্যে অবতরণ করে হিথরো বিমানবন্দরে। বঙ্গবন্ধুর তখন ৫১ বছর বয়সী বাংলাদেশের জনক। পরনে সাদা শার্ট, ধুসর স্যুট ও ওভারকোট। কড়া নিরাপত্তায় ভিআইপি লাউঞ্জে নেওয়া হয় তাঁকে। শুধু বাংলার মানুষ নয়, পৃথিবীর বহু মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধুকে ভিআইপি লাউঞ্জে নেওয়ার সময় এক ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে দেখে কেঁদে ফেলেন। তিনি কখনো ভাবেননি প্রিয় নেতাকে এত কাছ থেকে দেখবেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি বলেন, ‘স্যার আমরা সব সময় আপনার জন্য প্রার্থনা করেছি।’ এ বিষয়ে পরে ড. কামাল হোসেন লেখেন, ‘আই কান্ট ফরগেট দ্য রিমার্ক অব দ্য পুলিশ অফিসার।’ এ সময় বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দরে কিছু সময় অবস্থান করতে হয়। কারণ, পাকিস্তান থেকে বিমান ছাড়ার সময় তাঁর গন্তব্য নিয়ে কিছুই জানানো হয়নি। শুধু এটুকু বলা হয়, তিনি যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে পরবর্তী কর্মসূচি জানাবেন। তখন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন ইয়ান সাদারল্যান্ড। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ভারত বিভাগ দেখেন। সাদারল্যান্ডই প্রথম ভিআইপি লাউঞ্জে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। সাদারল্যান্ড বলেন, ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে লন্ডনের বিখ্যাত ক্লারিজেস হোটেলে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তখন বাংলাদেশ মিশনের উপপ্রধান ছিলেন রেজাউল করিম। তিনি খবর শুনেই ভিআইপি লাউঞ্জে আসেন। গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান।

বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় অতিথি

ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুর থাকার ব্যবস্থা করে। আর সে স্থান হলো, লন্ডনের সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেল ক্লারিজেস। তাঁকে ক্লারিজেসে নেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে লিমুজিন গাড়ি পাঠানো হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেটি ব্যবহার করেননি। তিনি বাংলাদেশ মিশনের উপপ্রধান রেজাউল করিমের গাড়িতে ক্লারিজেস যান। আর রেজাউল করিমই প্রথম বাংলাদেশি যিনি বঙ্গবন্ধুকে বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে সংবর্ধনা জানান। তখন বাংলাদেশ মিশনের দ্বিতীয় সচিব ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ। রেজাউল করিমের পর মহিউদ্দিন আহমেদ ভিআইপি লাউঞ্জে আসেন। সকাল প্রায় ৬টা ৩০ মিনিট। তখন তাঁরা হোটেলের দিকে রওনা হন।

বঙ্গবন্ধুকে ক্লারিজেস হোটেলে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ মিশনের দুটি গাড়ি ছিল। রেজাউল করিমের ‘ফোর্ড রুটিনা’ ও মহিউদ্দিন আহমেদের ‘অস্টিন’। বঙ্গবন্ধু সেদিন রেজাউল করিমের গাড়িতেই গেলেন। রেজাউল করিম নিজে গাড়ি চালিয়েছিলেন। লন্ডনের রাস্তায় তখন বৃষ্টি নামছিল। তিনি তাঁর এক লেখায় বলেন, সেদিন গাড়ি চালাতে ভয় পাচ্ছিলেন। যে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর গায়ে আঁচড় দিতে পারেনি, আজ পিছলা রাস্তায় দুর্ঘটনা হয়ে বঙ্গবন্ধুর না কোনো ক্ষতি হয়। সবার লাগেজ তোলা হয়েছিল মহিউদ্দিন আহমেদের গাড়িতে। সকাল ৯টায় ক্লারিজেস হোটেলে পৌঁছালেন। ব্রিটিশ সরকারের অতিথিরা এই হোটেলে থাকেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ বিশ্বনেতারা এখানে থেকেছেন।

ক্লারিজেস হোটেল যেন পল্টন ময়দান

বঙ্গবন্ধু ব্রিটেন সরকারের রাষ্ট্রীয় অতিথি। তারা তাঁকে লন্ডনের অভিজাত হোটেল ক্লারিজেসে থাকার ব্যবস্থা করে। কিন্তু তিনি লন্ডনের রাসেল স্কয়ারে কম দামি হোটেলে থাকতে চেয়েছিলেন। যেখানে সাধারণ বাঙালিরা সহজে তাঁর কাছে আসতে পারে। সাদারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুকে বিনীতভাবে জানান যে তাঁর নিরাপত্তার স্বার্থে এই অনুরোধ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা বা ইন্টারপোলের কাছে লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর প্রাণনাশের তথ্য ছিল। তবে সাদারল্যান্ড নিশ্চিত করেন বেশি সংখ্যক নেতা-কর্মী ও সমর্থককে তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হবে। সারা লন্ডনের বাঙালিরা জেনে যায় বঙ্গবন্ধুর ক্লারিজেস এসেছেন। সেদিন তিনি একটুও বিশ্রাম নেননি। কারণ, তাঁকে দেখার জন্য মানুষ অপেক্ষা করছে।

ইতিমধ্যে হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি হোটেলের সামনে জড়ো হয়েছে। লন্ডনের প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও দলে দলে বাঙালিরা এসেছেন। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে চান। অন্তত একবার দেখতে চান। ব্রিটিশ পুলিশের পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া খুবই কষ্টকর। বাংলাদেশ মিশনের লোকজন তাদের সহায়তা করেছে। এদিকে ব্রিটিশ সরকার কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়। তারা নিশ্চিত করতে চায় যে বঙ্গবন্ধু যেন ব্যালকনিতে এসে সবাইকে অভিবাদন না জানান। কিন্তু কে ঠেকায় জনতার নেতাকে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ইয়াহিয়া-ভুট্টো তাঁকে মারতে পারেনি। আর এখানে কে মারবে। তিনি মাঝেমধে৵ সু৵টের ব্যালকনিতে দাঁড়াচ্ছিলেন। উৎফুল্ল জনতাকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন। এটা এমন এক পরিস্থিতি যা লন্ডনের মানুষ আগে কখনো দেখিনি। এ যেন পল্টন ময়দান। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন। জনতার চিৎকারে মুখর ময়দান। এখনই ভাষণ শুরু করবেন বঙ্গবন্ধু।

সেদিন কতজন বাংলাদেশি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন তার সঠিক হিসাব নেই। তবে পাঁচ জন করে দেখার ব্যবস্থা করা হয়। তাঁরা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী, মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তি, যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালি ছাত্র ও পেশাজীবী ছিলেন। প্রথম দেখা করেছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা।

বাংলাদেশ মিশনের যারা দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন কাউন্সিলর রেজাউল করিম, সেকেন্ড সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমেদ, থার্ড সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমেদ জায়গিরদার, প্রেস সেক্রেটারি মহিউদ্দিন চৌধুরী, পরিচালক লুৎফুল মতিন, সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ও আনোয়ার হোসেন।

বিদেশি প্রতিনিধি ও বঙ্গবন্ধু

ভারতের হাইকমিশনার: ব্রিটেনে তখন ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন আপা বি পন্থ। তিনজন সহকর্মীসহ সকাল ১০টায় তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। এটি ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের কূটনীতিকের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে এক শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। বার্তাটি ছিল, ‘আপনি বন্দী ছিলেন, কিন্তু আপনার চিন্তা-চেতনা বন্দী ছিল না। আপনি নির্যাতিত জনগণের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।’ মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য বঙ্গবন্ধুও ইন্দিরা গান্ধীকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানান। গান্ধী বলেন, ‘আসলে আমরাই আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। কারণ, আপনিই আপনার দেশবাসীকে প্রেরণা জুগিয়েছেন।’

হ্যারল্ড ইউলসন: সে সময় যুক্তরাজ্যের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন হ্যারল্ড উইলসন। তিনি নিজে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সন্ধ্যায় দুই নেতা ক্লারিজেসে প্রায় ৩৫ মিনিট অন্তরঙ্গ আলোচনা করেন। ইউলসন কথা শুরু করেন ‘ইট ইজ গ্রেট টু সি ইয়োর এক্সেলেন্সি।’ বঙ্গবন্ধুকে তিনি মিস্টার প্রেসিডেন্ট বলে সম্বোধন করেন।

আর্নল্ড স্মিথ: হ্যারল্ড উইলসনের পর কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি ছিলেন কমনওয়েলথের প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর আগে পরিচয় ছিল। নানাভাবে কমনওয়েলথ বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল।

ব্রিটিশ এমপি পিটার শোর: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তখন কলকাতা ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এ দেশের শরণার্থীরা ছিল। নানাভাবে শরণার্থীদের সাহায্যের চেষ্টা করেন। বাংলাদেশ প্রশ্নে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আলোচনা করেন। জুন মাসে ২১৬ জন এমপি বাংলাদেশকে স্বীকৃতির জন্য ব্রিটিশ সরকারকে চাপ দেন। ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি পিটার শোর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দুইবার হোটেলে দেখা করেন। বাংলাদেশের স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়।

যাঁরা ফোনে কথা বলেছিলেন

সকাল সাড়ে ১০টা। ক্লারিজেস হোটেলের ১২২ নম্বর সু্৵টে বঙ্গবন্ধু। এখানে চারটি টেলিফোন। কলকাতা থেকে আসে প্রথম ফোনটি। সম্ভবত বাংলাদেশ মিশনের কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা কর্মকর্তা ফোন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলছেন যে তারা যেন চিন্তা না করে। তিনি নিরাপদে আছেন। জীবিত আছেন। ভালো আছেন। তিনি সবার সঙ্গে আছেন। ঢাকায় টেলিফোন করে বলতে বললেন, ‘বাংলাদেশ টিকে থাকার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পৃথিবীর কোনো শক্তি এ বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না।’

এরপর ঢাকা থেকে ফোন করেন তাজউদ্দীন আহমেদ। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তাজ কাঁদিসনে আমি এসে গেছি। শিগগিরই তোদের সঙ্গে দেখা হবে ইনশাঅল্লাহ।’ কলকাতা থেকে আবার ফোন এল।

১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট থেকে ফোন এসেছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিথ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে চান। একই লাইনে অপেক্ষায় রয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু একের পর এক টেলিফোনে কথা বলে যাচ্ছেন। তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিথ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গেও কথা বললেন।

সিহালা গেস্ট হাউস থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনার কণ্ঠ শুনেছিলেন। তখন তিনি নিশ্চিত হলেন যে অন্তত বড় মেয়ে বেঁচে আছেন। এত দিন পর এবার তিনি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সবার সঙ্গে কথা বললেন। এ সময় এক দারুণ আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শেখ কামালের কাছে বঙ্গবন্ধুর প্রথম প্রশ্ন ছিল তোমরা সবাই বেঁচে আছ তো?

বঙ্গবন্ধুর সংবাদ সম্মেলন

বঙ্গবন্ধুর আগমন ব্রিটিশ গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ব্রিটিশ সাংবাদিকেরা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন। এমনকি তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। শরণার্থীদের দুঃসহ জীবন দেখেছেন। গুলির মুখোমুখি হয়েছেন। ঢাকা, কলকাতা, দিল্লি, ইসলামাবাদ, লন্ডন, পিকিং, ওয়াশিংটনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন শহর থেকে যুদ্ধের গতি ও পরিণতি দেখেছেন। এত বড় যুদ্ধ যে নেতার নামে হয়েছে সেই তিনিই লন্ডনের ক্লারিজেসে। ব্রিটেনের নামকরা সাংবাদিকসহ প্রায় সবাই চলে এসেছেন।

তাঁরা অধিকাংশই বঙ্গবন্ধুর এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন করতে চায়। বঙ্গবন্ধুর এত ব্যস্ত শিডিউল ছিল যে কাউকে আলাদা সাক্ষাৎকার দেওয়া সম্ভব না। তিনি বেলা একটায় সবার জন্য করলেন সংবাদ সম্মেলন। কড়া নিরাপত্তায় দুই শতাধিক সাংবাদিক অংশ নেন। এ সম্মেলনে একটি বিবৃতি পাঠ করেন বঙ্গবন্ধু। বিবৃতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানিদের গণহত্যা, বিচারের নামে তাঁকে হত্যার চেষ্টা, বিশ্বের সহযোগিতা, ভুট্টোর অনুরোধ, কেন লন্ডনে গেলেন, বাংলাদেশকে কীভাবে গড়ে তুলবেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ অনেক বিষয় তুলে ধরেন।

বঙ্গবন্ধু গভীর কৃতজ্ঞতা জানান মুক্তিযোদ্ধা ও লাখো শহীদের প্রতি। যুদ্ধে সহায়তাকারী দেশ ও মানুষের প্রতি। বিশ্বের দেশগুলোকে অনুরোধ করেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এক অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা।’ জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য বাংলাদেশ অনুরোধ করবে। বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশকে ধন্যবাদ জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন অবিসংবাদিত সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে।’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, তিনি এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চান না। ফিরে যেতে চান তাঁর জনগণের কাছে। বঙ্গবন্ধু ৯ মাস অবরুদ্ধ ছিলেন। বিশ্ব জগতের অনেক কিছুই তিনি জানতেন না। তারপরও এমন অসাধারণ এক সংবাদ সম্মেলন করলেন যে সাংবাদিকেরা ভীষণ অভিভূত হলেন।

বঙ্গবন্ধু-হিথ গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক

৮ জানুয়ারির দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ—দুই নেতার বৈঠক। এডওয়ার্ড হিথ তখন লন্ডন থেকে প্রায় ৪১ মাইল দূরে কাউন্টি আবাসে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগমনের কথা শুনে সব কর্মসূচি বাদ দেন। দ্রুত তিনি ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। এটা প্রধানমন্ত্রীর হিথের কার্যালয়।

সেদিন বেলা দুইটায় দুই নেতার মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক হয়। হিথ বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন। বাংলাদেশের স্বীকৃতি, দুই দেশের সম্পর্ক, দেশ পুনর্গঠনে অর্থ সাহায্য, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য পদ গ্রহণ, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচন হয়। দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর এমন ভাবনায় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী দারুণ খুশি হন।

কোনো দেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে ব্রিটেন কতকগুলো বিষয় বিবেচনা করে, তা হলো দেশের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ, জনপ্রিয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ এমন কিছু বিষয়। বাংলাদেশে তখনো ভারতীয় সৈন্য রয়েছে। এ অবস্থায় ব্রিটেনের পক্ষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান। তবে আর্থিক সাহায্যসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেবেন বলে এডওয়ার্ড হিথ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে কথা দেন। একই সঙ্গে হিথও ইতিহাসের অংশ হলেন। তিনিই প্রথম কোনো রাষ্ট্রনেতা যিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বললেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন