জীবনের শেষ জেল

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

সেলের পাশে কবর

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতটি ছিল ইতিহাসের ভয়াবহ নৃশংসতার রাত। এ রাতে প্রায় একই সঙ্গে দুটো চরম বেদনার ঘটনা ঘটে। একদিকে গণহত্যা, অন্যদিকে দেশের মাটি ও মানুষের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার। তারা যেমন রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিল বাঙালির প্রতিরোধ, তেমনি পাকিস্তানি কারাগারে নিঃসঙ্গ বন্দী রেখে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী চেতনা। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি কোথায় আছেন। আদৌ বেঁচে আছেন, না মৃত্যু হয়েছে। একমাত্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার ঘোষণা করছিল তিনি বাঙালিদের সঙ্গে রয়েছেন। পরে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল। এর আগে ইয়াহিয়া তাঁর প্রতারণামূলক ভাষণে বলেছেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) এ দেশের ঐক্য ও সংহতির ওপর আঘাত হেনেছেন। এই অপরাধের শাস্তি তাঁকে পেতে হবে। ১২ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে ক্ষমতালোলুপ দেশপ্রেমবর্জিত কতক মানুষ, সেটা আমরা হতে দিতে পারি না। আমি সেনাবাহিনীকে আদেশ দিয়েছি তাদের কর্তব্য পালন এবং পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য।...আর রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।’

আহমেদ সেলিম পাকিস্তানের একজন লেখক ও কবি। পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দিজীবন নামে তিনি একটি বই লিখেছেন। এটি অনুবাদ করেছেন মফিদুল হক। অনুবাদক বলেছেন যে লেখক আহমেদ সেলিমের কাছে এটা ছিল বিস্ময় যে বঙ্গবন্ধু কীভাবে দিনের পর দিন ক্ষুদ্র নির্জন প্রকোষ্ঠে নিঃসঙ্গ বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। নির্জন কারাবাসের তীব্র যন্ত্রণা লিখে প্রকাশ করা কঠিন। যিনি আপন মানুষ ছেড়ে হাজার মাইল দূরে চরম বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে নির্জন সেলে দিন কাটাচ্ছেন, তাঁর মানসিক অবস্থা কল্পনা করা যায় না। তিনি বন্দিজীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা কীভাবে বরণ করেছিলেন, সেটা এক বিস্ময়।

বঙ্গবন্ধুর একটা উক্তি থেকে বোঝা যায় পাকিস্তানের জেলজীবন কত ভয়ংকর ছিল। ‘আমার সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না।’—বঙ্গবন্ধু এভাবেই তাঁর জীবনের শেষ জেলের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন।

ইয়াহিয়া ও ইরানি সাংবাদিক আমির তাহেরি দুজনে জনগণকে দেখাতে চান যে বঙ্গবন্ধুর মানসিক সমস্যা হয়েছে। কিন্তু এটা ছিল একটা কূটচাল। সে সময় লেখক আহমেদ সেলিম পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনকে জানার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, ‘কারাগারে শেখ মুজিব সব সময় শান্তভাব বজায় রাখতেন। অন্তরের অস্থিরতার কোনো প্রকাশ যেন কারা কর্তৃপক্ষ দেখতে না পায়, সে বিষয়ে ছিলেন সজাগ।’

কালকেই গুলি করে মারছি না

বঙ্গবন্ধুকে পাহারা দেওয়ার জন্য রক্ষী ছিল। তাদের পালা বদল হতো। তারা তাঁকে খাবার দেওয়ার সময় সালাম দিত। একমাত্র সালামের উত্তর দেওয়া ছাড়া তিনি কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। এদিকে ইয়াহিয়ার কড়া নির্দেশ—বঙ্গবন্ধুর প্রতিমুহূর্তের গতিবিধি যেন ইসলামাবাদে জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর এই দুঃসহ জীবনের কথা কখনো লেখেননি। পাকিস্তানি লেখক আহমেদ সেলিমের বই থেকে সেই জীবনের কিছুটা জানা যায়। তাঁকে হাজার মাইল দূরের কারাপ্রকোষ্ঠে বন্দী করে পাকিস্তানি শাসকচক্র চেয়েছিল এ দেশের মানুষকে নেতৃত্বশূন্য করতে। কিন্তু ইয়াহিয়া জানতেন না তিনি কোটি বাঙালির অন্তরে নিরন্তর বেঁচে থাকবেন।

বঙ্গবন্ধুকে করাচিতে রাখা হলো না। কঠোর গোপনীয়তায় নেওয়া হলো লাহোর থেকে ৮০ মাইল দূরে। এটা ছিল ফয়সালাবাদের প্রধান কারাগার লায়ালপুর জেল। ইয়াহিয়া তাঁকে মানসিকভাবে কষ্ট দিতে চেয়েছিলেন। তাই শহর থেকে অনেক দূরে নিলেন। যেখানে ভয়াবহ তাপমাত্রা। এখানে বন্দীদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। এ অসহ্য, অসহনীয় গরমেও তাঁর সেলে একটি ফ্যান ছিল না। তার ওপর নিঃসঙ্গ।

পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বন্দী থাকার প্রথম খবর বের হয় ১৯ জুলাই ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ। এরপর ৮ আগস্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সানডে টাইমস-এর সংবাদদাতাকে নিজেই জানান পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বোচ্চ শ্রেণির কারাগারে আটক শেখ মুজিব জীবিত ও সুস্থ আছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আজকের পর শেখ মুজিবের জীবনে কী হবে, সে বিষয়ে তিনি ওয়াদা করে কিছু বলতে পারেন না।’ ‘মুজিবকে কালকেই আমি গুলি করছি না’, এই শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদভাষ্যে ইয়াহিয়া খান আরও বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানি খাবারের কারণে শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য সাময়িকভাবে খারাপ হয়েছিল, তবে এখন তাঁকে বাঙালি খাবার দেওয়া হচ্ছে। তাঁর ওজন আবার বেড়েছে। তিনি হররোজ গালগপ্পো করেন। কথার তুবড়ি ছোটান।’ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরও জানান, ‘বিছানা, ফ্যান ও গরম পানির ব্যবস্থা রয়েছে। দেখাশোনার জন্য একজন ডাক্তারও রয়েছে।’

এর মধ্যে ১ আগস্ট ইরানের কায়হান ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন নিয়ে বড় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ সংবাদে বলা হয়, ‘আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশদ্রোহের অভিযোগে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে। সর্বোচ্চ শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড।’

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
ছবি: সংগৃহীত

৪ ডিসেম্বর মৃত্যুর আদেশ

ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য ও আমির তাহিরির প্রতিবেদনে মিল রয়েছে। তাঁরা দুজনেই ভাবতে থাকেন বঙ্গবন্ধু যেন পাগল হয়ে যান। কারাগারের বিরূপ পরিবেশ, ভয়াবহ গরম, সর্বোপরি এমন নির্জন কারাবাস কারও মনোবল গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বঙ্গবন্ধু এই দুঃসহ পরিস্থিতি জয় করলেন জনগণের প্রতি ভালোবাসা ও মনের অপরিসীম জোর দিয়ে। সঙ্গে তিনি এটাও ভাবতেন নিয়তির ওপর কারও হাত নেই। নিয়তিতে যা আছে সেটাই হবে।

১৯ জুলাই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর আসন্ন বিচারের বার্তা প্রকাশ করল। এর পেছনে ছিল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। ৬ থেকে ৮ জুলাই মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার নয়াদিল্লি সফর করেন। এরপর পাকিস্তানে আসেন। সেখানে তিনি অসুস্থতার ভান করেন। অত্যন্ত গোপনে পাকিস্তান থেকে চীনে যান। সেখানে মাও সে তুংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। কিসিঞ্জারের চীন সফর ইয়াহিয়া খানকে বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রহসনের সবুজসংকেত দিয়েছিল। সামরিক আদালতে ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু করেন।

বঙ্গবন্ধুকে একজন প্রবীণ আইনজীবী দেওয়া হয়েছিল। তাঁর নাম এ কে ব্রোহি। আদালতের কার্যক্রমের শুরুতে ১২ দফা অভিযোগনামা পড়ে শোনানো হয়। এর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাসহ বিভিন্ন অভিযোগ। ছয়টি অপরাধের জন্য শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। আদালতে ইয়াহিয়া খানের একটি ভাষণের টেপ বাজিয়ে শোনানো হয়। এই টেপ শোনার পর বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন এখানে যুক্তির কোনো দাম নেই। এ হচ্ছে এক প্রহসনের বিচার মাত্র। বঙ্গবন্ধু কোর্টে দাঁড়িয়ে বিচারপতিকে বলে দিলেন তাঁর উকিলের দরকার নেই। কারণ এ হলো এক গোপন বিচার। বঙ্গবন্ধু একজন বেসামরিক ব্যক্তি। অথচ তাঁর জন্য করা হয়েছে কোর্ট মার্শাল। ইয়াহিয়া খান একদিকে প্রেসিডেন্ট, অন্যদিকে প্রধান সামরিক শাসক। এ বিচারের রায়ও তিনিই অনুমোদন করবেন। আদালতও গঠন করেছেন তিনি।

আদালতকক্ষে কী ঘটেছে, এটা নিয়ে তাঁর ভাবনা নেই। বিচারের কোনো কার্যক্রমেই তিনি অংশ নেননি। এভাবেই প্রহসনের বিচারের প্রতিবাদ করেন।

৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের সামরিক বিমানঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। ৪ ডিসেম্বর সামরিক আদালতের বিচারে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়। এবার লায়ালপুর জেল থেকে বঙ্গবন্ধুকে আনা হয় মিয়ানওয়ালি জেলে। এখানে তাঁর দণ্ডাদেশ কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হতে থাকে। যে সেলে তিনি ছিলেন, তার পাশেই কবরও খোঁড়া হয়। এদিকে বাংলার যুদ্ধ পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল। দেশের মাটিতে কার্যকর হতে যাচ্ছে ২৫ মার্চ রাতে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষণা। ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানে আছ এবং যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’

শেষ সৈন্য আত্মসমর্পণ পর্যন্ত বাংলার আপামর মানুষ যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী চূড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ যেদিন স্বাধীন হলো, সেদিনই মিয়ানওয়ালি কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি গোয়েন্দা পুলিশের কজন কর্মকর্তার উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সেদিন বঙ্গবন্ধু প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ১০ জানুয়ারি যখন বঙ্গবন্ধুর বিমান বাংলার মাটি স্পর্শ করে, তখন প্রায় ১০ লাখ লোক তাঁকে স্বাগত জানায়। পাকিস্তানের লায়ালপুর ও মিয়ানওয়ালি জেলই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ জেল।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন