ব্রিটিশ শাসন, পূর্ব বাংলা ও পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

জেলের ভেতর ছোট ছোট জেল

বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনের শুরু হয়েছিল সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পথ ধরে। আর শেষ হলো পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির মধ্য দিয়ে। উপমহাদেশজুড়ে ব্রিটিশ শাসন। তিনি তখন স্কুলে পড়েন। সহপাঠীকে মুক্ত করতে গিয়ে জীবনে প্রথম সাত দিন জেলে থাকতে হয়েছিল।

বাকি জেলজীবনের ইতিহাস পূর্ব বাংলা ও পাকিস্তানে। পৃথিবীতে এমন রাষ্ট্রনায়ক খুব কম আছেন যিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় জেলে কাটিয়েছেন। দীর্ঘ মাস, বছর কারাগারে থাকায় তাঁর সন্তানেরা স্নেহ–ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। একবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখলেন, ‘শেখ কামাল আব্বাকে কখনো দেখে নাই, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, আব্বা আব্বা বলে ডাকছি, ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে…ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলে ডাকি।’ জেলজীবন বঙ্গবন্ধুকে সন্তানদের কাছে এমন করে তুলেছিল।

বঙ্গবন্ধু নির্যাতন-নিপীড়নে বিদ্ধ হয়েছেন বারবার। নিজের জীবন দিয়ে মুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন বাঙালি জাতিকে। কারাবাসের দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই—তারা জানে না জেল কী জিনিস। বাইরে থেকে মানুষের যে ধারণা জেল সম্বন্ধে, ভেতরে তার একদম উল্টা। জনসাধারণ মনে করে চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, ভেতরে সমস্ত কয়েদি এক সাথে থাকে, তাহা নয়। জেলের ভেতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে।’

কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, জেলজীবনের যন্ত্রণার কথা। আরও লিখেছেন কারাগারে কয়েদি, অপরাধ জগৎ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দুঃখ-দুর্দশা, গণমাধ্যম ও শাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচরের কথা। বঙ্গবন্ধু রাজবন্দী হিসেবে জেল খেটেছেন। সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খেটেছেন। তাই তিনি নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছেন সব ধরনের কয়েদির অবস্থা।

জেল কোডে আছে, কোনো কয়েদিকে তিন মাসের বেশি একাকী রাখা চলবে না। একাকী রাখার কারণে বঙ্গবন্ধু অনশনও করেছেন। শাস্তি দেওয়ার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক বন্দীদের একাকী রাখত। কারাগারে একাকী থাকা যে কত কষ্টের তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারে না।

কারাগারে অন্য বন্দীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু দেখা করা বা কথা বলার সুযোগ পেতেন না। তাঁর বর্ণনায় জানা যায়, ‘কারও সঙ্গে আলাপ করার উপায় নাই। কারও সঙ্গে পরামর্শ করারও উপায় নাই। সান্ত্বনা দেওয়ার কেহ নাই। কারাগারের ভেতর একাকী রাখার মতো নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে?’

ছেলেমেয়েরা ঈদ করবে না

বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন, ‘জেলে রাতটাই বেশি কষ্টের। আবার যারা আমার মতো একাকী নির্জন স্থানে থাকতে বাধ্য হয়, যাকে ইংরেজিতে বলে সলিটারি কনফাইয়েনমেন্ট, তাদের অবস্থা কল্পনা করা যায় না।’ ঈদের দিনও তাকে একা থাকতে হতো। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘একাকী কি ঈদ উদ্‌যাপন করা যায়?’ তারপরও যতটা সম্ভব অন্য বন্দীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতেন। নামাজ পড়ার পর শত শত কয়েদি বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ফেলেন। সবার সঙ্গে হাত মেলাতে প্রায় আধা ঘণ্টা লেগে যায়। তিনি জানতেন, জীবনের আরও অনেক ঈদ হয়তো জেলে কাটাতে হবে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আগামী ১৩ জানুয়ারি ঈদের নামাজ। ছেলেমেয়েরা জামাকাপড় নেবে না। ঈদ করবে না কারণ, আমি জেলে।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আজ কোরবানির ঈদ। গত ঈদেও জেলে ছিলাম। এবারও জেলে। বন্দী জীবনে ঈদ উদ্‌যাপন করা একটি মর্মান্তিক ঘটনা।’ ঈদের দিন পাকিস্তানের জেলে কাটানোর স্মৃতিচারণা করেছেন বঙ্গবন্ধুর এভাবে, ‘আমার প্রিয় জনগণ কীভাবে তাদের ঈদ উৎসব পালন করছে? এই প্রশ্ন আমি করলাম, জানি না কাকে! সেই দিন, আবার কখনো তাদের দেখা পাব কি না সেটা না জেনেই, আমি মোনাজাত করে আমার জনগণের মঙ্গল ও নিরাপত্তা দয়াময় আল্লাহতায়ালার হাতে সমর্পণ করলাম। এটাই ছিল আমার ঈদ।’

জেলজীবনে মাঝেমধ্যেই বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তারই একটি চিত্র পাই ২৯ জুলাই ১৯৬৬ তারিখের কারাগারের রোজনামচায়। এদিন বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘সারা দিন ব্যথায় কাতর। ডাক্তার ক্যাপ্টেন সামাদ সাহেব এলেন আমাকে দেখতে। খাবার ওষুধ দিলেন, আরও দিলেন মালিশ। বিছানায় পড়ে রইলাম। সন্ধ্যার দিকে কষ্ট করে বের হয়ে বাগানের ভেতর আরামকেদারায় কিছু সময় বসে আবার শুয়ে পড়লাম। খুবই কষ্ট পেতেছি।’

এর আগে ১৯৫০ সালে গোপালগঞ্জ জেলে থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর দুর্বল হার্ট, চক্ষুযন্ত্রণা ও বাঁ পায়ে বাতজ্বরের ব্যথা হয়। খুলনা জেলে ভীষণ জ্বর, মাথা ও বুকের ব্যথা ধরা পড়ে। চোখের অসুখও বাড়ে। ভালো চিকিৎসার দাবিতে তিনি ফরিদপুর জেলে অনশন করেন। জেলের চিকিৎসকেরা জোর করে নাকে টিউব ঢুকিয়ে তরল খাবার প্রবেশ করালে ক্ষত সৃষ্টি হয়। আর এতে হার্টের অবস্থা খারাপ হয়। পালপিটিশন বাড়ে। নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। ১৯৬৬ সালে জেলে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু অনিদ্রা ও ক্ষুধামান্দ্যয় ভোগেন।

একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও নির্জন কারাবাসেও বঙ্গবন্ধুর মনোবল নষ্ট হয়নি। অটল ছিল মনের দৃঢ়তা। ১৯৬৬ সালের ২৯ জুন কারাগারের রোজনামচায় তিনি লেখেন, ‘খুব সাবধানে থাকি আমি জেলে। শরীর রক্ষা করতে চাই, বাঁচতে চাই, কাজ আছে অনেক আমার। তবে একটা ছেড়ে আরেকটা ব্যারাম এসে দেখা দেয়।’

১৯৭১ সালের ছাব্বিশে মার্চের প্রথম প্রহর। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে কমান্ডো স্টাইলে গ্রেপ্তার করে। প্রথমে লায়ালপুর ও পরে মিয়ানওয়ালি কারাগারে অতি ক্ষুদ্র সেলে বন্দী রাখে। সেখানে প্রচণ্ড গরমেও তাঁর সেলে কোনো বৈদ্যুতিক ফ্যান ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর জন্যই খোঁড়া হচ্ছে কবর

পর্বতমালায় ঘেরা মিয়ানওয়ালি কারাগার। সেখানে প্রায়ই শিলাবৃষ্টি নেমে আসত। ধূসর মেঘগুলো পাহাড়ের গায়ে মিশে থাকত। ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে পাতলা বিবর্ণ একটি কম্বল মুড়ি দিয়ে বন্দী বঙ্গবন্ধুর দিন কাটত। একদিন প্রচণ্ড বেগে নেমে এল ঝড়। সঙ্গে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত। আকাশজুড়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টির জল বাতাসে ধাক্কা খেয়ে জানালা দিয়ে আছড়ে পড়ছে। কনকনে ঠান্ডা। এমন ঠান্ডায় একটা কম্বলে শীত মানে না। বৃষ্টির বড় ফোঁটা কাঁটার মতো বঙ্গবন্ধুর মুখে বিঁধতে লাগল।

একদিন দুপুরবেলায় বঙ্গবন্ধু হঠাৎ বাইরে তাকান। দেখতে পেলেন তাঁর সেলের ১০ গজ সামনে কাঁটাতারের বেড়া। সেই বেড়া ঘেঁষে কয়েকজন কয়েদি গর্ত খুঁড়ছেন। বঙ্গবন্ধু কিছুটা অবাক হলেন। বুঝতে অসুবিধা হলো না তাঁর জন্যই খোঁড়া হচ্ছে এ কবর। সম্ভবত দু–এক দিনের মধ্যেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে চলেছে।

ইয়াহিয়ার ইচ্ছা ছিল, বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা। মার্শাল ল কোর্টে নেওয়ার সময় যেন তিনি সুস্থ থাকেন—এ বিষয়টি তাঁর মনে ছিল। এ জন্য তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়নি। তাঁর জন্য বাঙালি বাবুর্চি ও একজন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া বলেন, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, খুব শিগগির বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু করবেন। বিচার হবে সিক্রেট মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কী ধরনের চার্জ গঠন হবে সেটা তিনি বলেননি। আবার এটা বলেন যে চার্জে মৃত্যুদণ্ডের কয়েকটি ধারা থাকবে।

বঙ্গবন্ধু মিয়ানওয়ালি কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। তিনি জানেন না তাঁর স্বপ্ন সত্য হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তিনি শুধু জানতেন, দুয়ারে করাঘাত করছে মৃত্যু। সময়ের চাকায় ভর করে সেদিন ছিল ২৬ ডিসেম্বর। গভীর রাত। তীব্র শীত। তিনি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলেন শীতে। হঠাৎ কানে এল একটা চলন্ত গাড়ির আওয়াজ।

জানালা দিয়ে তাকাতেই লক্ষ করলেন, একটা ট্রাক আসছে ধীরে ধীরে। ট্রাকটা সেলের সঙ্গে লাগোয়া গার্ড হাউসের সামনে দাঁড়াল। বাইরে ছোটাছুটির শব্দ। হঠাৎ লৌহকপাট খুলে গেল। চারজন সৈন্য ভেতরে ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে দাঁড়াল।

সামনে এসে দাঁড়ালেন জেল গভর্নর হাবিব আলী। মাথায় মিলিটারি ক্যাপ; গায়ে রেইনকোট জড়ানো। হাবিব আলী কর্কশস্বরে বললেন, আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন; আমি আপনাকে একটা নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।

বঙ্গবন্ধু ভাবলেন, তখনই হয়তো তাঁকে অন্ধকারে গুলি করে মেরে ফেলবে! কিন্তু এতসবের কী প্রয়োজন ছিল! সেলের সামনের গর্তের পাশে নিয়েও তো গোপনে মেরে ফেলতে পারত। এত দূরে নিয়ে এল কেন?