জীবনের প্রথম জেল

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০—১৫ আগস্ট ১৯৭৫) যখন তরুণ
ছবি: সংগৃহীত

আমি পালাব না

বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনন্য, সাদামাটা অথচ দৃঢ়চেতা এক নেতা। বিস্ময়কর বজ্রকণ্ঠের অধিকারী। এসব কারণে তাঁকে আলাদাভাবে চেনা যায়। তিনি ও বাংলাদেশ যেন অভিন্ন এক সত্তা। তিনি সব সময় সংগ্রামী জনতার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর আদর্শ, দূরদর্শিতা ও আপসহীন নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পায় হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। আমরাও হাজার বছরের বাংলায় পেয়েছি একজন বঙ্গবন্ধুকে। যিনি ছিলেন এ দেশের মানুষের মুক্তির অগ্রনায়ক। বাঙালিকে শোষণ–বঞ্চনা থেকে রক্ষার জন্য এক যুগের বেশি সময় যিনি কারাবন্দী ছিলেন। তাঁর জীবন ঘিরে রয়েছে অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-জুলুমের এক দীর্ঘ ইতিহাস। একজন মানুষ তাঁর ৫৪ বছরের জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন!

ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অসমসাহসী। তখন মাত্র স্কুলে পড়েন। সে সময় থেকেই বিভিন্ন সামাজিক কাজ করেন। অনেক বিষয়ের নেতৃত্ব দেন। অন্যায়ের প্রতিবাদে সামনে থাকেন। এ জন্য তাঁকে বারবার জেলে যেতে হয়। জীবনে প্রথম যখন জেলে যান, তখন তিনি স্কুলছাত্র। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায় সব সময় স্নায়ুযুদ্ধ চলে আসছে। কিন্তু সমস্যা হয় তখন যখন এটা আর স্নায়ুর মধ্যে থাকে না, ওখান থেকে বাইরে আসে।

সেটা ছিল ১৯৩৮ সাল। সে সময় শেরেবাংলা ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলার দুই অবিসংবাদিত নেতা। তার ওপর শেরেবাংলা অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। শহীদ সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। এমন দুই নেতা গোপালগঞ্জে আসবেন। বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। এ সভা নিয়ে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শুরু হলো বিরোধ। কোনো কোনো মুসলমানের ওপর অত্যাচার হলো। এর মধ্যে একজনের নাম আবদুল মালেক। তিনি আবার বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী। একদিন সন্ধ্যায় তাঁকে হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে গেল। শুধু ধরেই আনেনি, মারপিট করেছে। খন্দকার শামসুল হক ও মোক্তার বঙ্গবন্ধুকে বললেন যে, ‘তোমার সাথে ওদের বন্ধুত্ব আছে। যদি পারো তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসো।’ তিনি আর দেরি করলেন না। কয়েকজন ছাত্র নিয়ে সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে গেলেন। মালেককে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলেন। সেখানে রমাপদ দত্ত নামে একজন ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখেই গাল দিলেন। বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদ করলেন। ছেলেদের খবর দিলেন। এদিকে রমাপদরা থানায় খবর দিয়েছে।

এরই মধ্যে তিনজন পুলিশও এসে হাজির। বঙ্গবন্ধু আবদুল মালেককে ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেন। কোনো কাজ হলো না। এ সময় তিনি তাঁর মামা শেখ সিরাজুল হক ও শেখ জাফর সাদেককে খবর দিলেন। দলবল নিয়ে তাঁরা ছুটে এসেছেন। ইতিমধ্যে দুই পক্ষের মারপিট শুরু হয়ে গেছে। দরজা ভেঙে মালেককে নিয়ে আসা হয়। এটা নিয়ে শহরে খুব উত্তেজনা। বঙ্গবন্ধুকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। কিন্তু হিন্দু নেতারা মিটিং করে মামলা করে দিল। হুকুমের আসামি হলো খন্দকার শামসুল হক ও জনাব মোক্তার।

বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে বলা হয়েছে তিনি খুন করার চেষ্টা করেছেন, লুটপাট ও দাঙ্গা লাগিয়ে দিয়েছেন। তখন থানা, কোর্ট সব জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রভাব। অনেককে আসামি করা হয়েছে। গণ্যমান্য ঘরের ছেলেদের প্রায় কেউ বাদ যায়নি। খুনের ডাহা মিথ্যা অভিযোগ আনা হলো বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। অথচ ঘটনা হলো রমাপদর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মারামারি হয় একটা লাঠি দিয়ে। রমাপদ প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে লাঠি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধুও লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। এ জন্য তাঁর মাথা ফেটে যায়।

সকাল নয়টার মধ্যেই অনেককে গ্রেপ্তার করে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুর বাবা ছিলেন বেশ সম্মানিত। তাঁদের বাড়ি যেতে দারোগা সাহেব একটু লজ্জা পাচ্ছিলেন! দারোগা আশা করছিলেন বঙ্গবন্ধু যেন কোথাও চলে যান। বঙ্গবন্ধুর এক ভাইও বললেন, ‘মিয়াভাই, পাশের বাসায় একটু সরে যাও না।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘যাব না, আমি পালাব না। লোকে বলবে, আমি ভয় পেয়েছি।’

সাত দিন পর জামিন

দারোগা সাহেব বঙ্গবন্ধুর বাবাকে সবকিছু বললেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও দেখালেন। তাঁকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। দারোগা সাহেব একজন সিপাহি রেখে গেলেন যেন বেলা ১১টার মধ্যে থানায় পৌঁছায়। তা না হলে জামিন পেতে অসুবিধা হবে। তিনি থানায় এসে দেখেন তাঁর মামাসহ আরও অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে কোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। হাতকড়া দেয়নি। তবে সামনে-পেছনে পুলিশ ছিল। কোর্ট দারোগার রুমের পাশেই কোর্ট হাজত। বঙ্গবন্ধুকে দেখেই দারোগা বললেন, ‘মজিবর খুব ভয়ানক ছেলে। ছোরা মেরেছিল রমাপদকে। কিছুতেই জামিন দেওয়া যেতে পারে না।’

বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাজে কথা বলবেন না, ভালো হবে না।’ দারোগা সাহেব অন্যদের বললেন, ‘দেখো ছেলের সাহস!’ বঙ্গবন্ধুকে সবাই কথা বলতে নিষেধ করলেন। মুসলমান উকিলেরা বঙ্গবন্ধুসহ সবার জামিনের আবেদন করলেন। মাত্র একজন ছাড়া কারও জামিন হলো না। কোর্ট দারোগা হাতকড়া পরাতে হুকুম দিলেন। জেলহাজতে পাঠানোর হুকুম হলো। সবাই জেলে এলেন। এটা ছিল সাবজেল। একটা মাত্র ঘর। বাড়ি থেকে বিছানা, কাপড় ও খাবার দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। শেষ পর্যন্ত সাত দিন পরে তিনি জামিন পেলেন।

১০ দিনের মধ্যে অন্য সবাই জামিন পেল। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে টেলিগ্রাম করা হলো। লোকও চলে গেল কলকাতায়। এলাকায় ভীষণ উত্তেজনা। হিন্দু সম্প্রদায়ের উকিলদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাবার ভালো সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব ছিল। দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হলো। ঠিক হলো মামলা চলবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুদের পনেরো শ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সবাই মিলে সেই টাকা দিলেন। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনে প্রথম জেল।

আশফাকুজ্জামান: কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংগঠক

আরও পড়ুন