একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন

অলংকরণ: আনিসুল হক

সময় গড়িয়েছে প্রায় ৫০ বছর। ১৯৭১ সাল। ৭ মার্চের এক বিকেল। ২টা ৪৫ মিনিট। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন। শেষ করেন ৩টা ৩ মিনিটে। তখন কি কেউ ভেবেছিল ১৮ মিনিটের এ ভাষণের মধ্য দিয়ে আসবে একটি দেশের স্বাধীনতা। পৃথিবীর দুর্লভ ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেসকো সংরক্ষণ করবে এ ভাষণ। অনুবাদ হবে কত ভাষায়। এর ঐশ্বর্য আলোচিত হবে দেশ-বিদেশে। এ ভাষণের দৃপ্ত আহ্বানে লাখ লাখ অস্ত্রহীন মানুষ সেদিন যুদ্ধে নেমেছিল।

অবিভক্ত ভারত থেকে পাকিস্তান। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ। দীর্ঘ বছর বঙ্গবন্ধু আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। রুখে দাঁড়িয়েছেন শোষণ, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আজীবন থেকেছেন আপসহীন। রাজনৈতিক জীবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে আন্দোলনে। ‍মৃত্যু পর্যন্ত জীবন উৎসর্গ করেছেন অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন উপমহাদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদের একজন।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন। ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে ইতিহাসের স্মরণীয় জয় অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। দিন গড়িয়ে যায়, কোনোভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে না পাকিস্তান সরকার। কেবলই ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে।

এরই মধ্যে দ্রুত নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। একপর্যায়ে ইয়াহিয়া সরকার ৩ মার্চ অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করে। আবার ১ মার্চ সেটা স্থগিত করে। এবার বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ।

সেদিন প্রায় সবাই রাজপথে নেমে আসে। এক কণ্ঠে স্লোগান দেয়—

‘তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা মেঘনা যমুনা’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৩ বছর যাবৎ একই ষড়যন্ত্র করছেন, আর ষড়যন্ত্র করবেন না।’

পূর্ব বাংলায় আগুন জ্বলে ওঠে। সারা দেশে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণের সৃষ্টি হয়। প্রচণ্ড চাপে আবার ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বান করেন। এমন একটি কঠিন বাস্তবতাকে সমানে রেখে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন বলে জানিয়ে দেন।

কিছু মানুষ ছাড়া সবাই স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তিনি মঞ্চে ওঠেন। আর শুরু হয় জনতার স্লোগান—

বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

শেখ মুজিবের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

এসব স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে সেদিন ফাগুনের আকাশ–বাতাস। একটু এদিক-সেদিক হলেই সহস্র মানুষের মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। লাখ লাখ সম্মোহিত মানুষ তাকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর দিকে। তিনি সূচনা করলেন—

‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ–ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম?’

বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস…।’ গভীর মমতায় বঙ্গবন্ধু যেন তাঁর শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি। ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না…। আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।’

বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের কঠিন সত্যগুলো জানতেন। তিনি জানতেন বিশ্বের বহু দেশের স্বাধীনতার আন্দোলন কীভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে চিহ্নিত হয়েছে। ভাষণে তিনি বাংলার ইতিহাসের কথা বললেন। পাশাপাশি বললেন দীর্ঘ বছর বাঙালিকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কথা। হত্যা-নিপীড়ন-জুলুমের কথা। তারপরও তিনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে বারবার শান্তিপূর্ণ আলোচনার চেষ্টা করেছেন। এসব প্রসঙ্গ তুলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তিনি বার্তাই দিলেন যে বাঙালিরা শান্তির পক্ষে।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে রাখলেন। এর ফলে পূর্ব বাংলায় মূলত বঙ্গবন্ধুর শাসন কায়েম হলো। প্রায় সবকিছু অচল হয়ে গেল। সেদিন বঙ্গবন্ধুর এই দূরদর্শিতায় মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হননি। এ জন্য যুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে বিশ্বসমাজ এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে।

আরও পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি জাতিকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। ইউনেসকো এ ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ভাষণকে ইতিহাসের প্রতিশোধ হিসেবে তুলনা করেছেন। কারণ, স্বাধীন দেশে দীর্ঘ সময় এর প্রচার নিষিদ্ধ ছিল।

এই ভাষণ ইউনেসকোর ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু নয় বরং ইউনেসকোই এই ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত হয়েছে। কারণ, এখন তাদের কাছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণটি আছে। এমনটা তারা বলতে পারবে।’

বঙ্গবন্ধু পুরোপুরি বুঝেছিলেন, একটি জাতি স্বাধীন হলেই সে মুক্ত হয় না। স্বাধীনতা রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক। আর মুক্তি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক। বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন, পাকিস্তান স্বাধীন হলেও তার নাগরিকেরা মুক্তির স্বাদ পায়নি। ভাষণের শুরুতে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়।’ আবার বক্তৃতার শেষে বলেছেন, ‘এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শন ম্যাকব্রাইড এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি। সাম্য নিশ্চিতকরণ ও সম্পদের বৈষম্য দূর করার মধ্যেই নিহিত স্বাধীনতার আসল সার্থকতা। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চের ভাষণে।’

বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যুদ্ধ করেই জয় ছিনিয়ে আনতে হবে। তাই তাঁর ভাষণে যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারব।’

কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’

আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বঙ্গবন্ধু ধারণা করেছিলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করে ভিন্ন পথে পরিচালিত করতে পারে। তাই বক্তৃতার শেষ দিকে তিনি জনতাকে শান্ত ও অহিংস থাকার উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘...শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, নন-বেঙ্গলি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে, আমাদের ওপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর অন্যতম হলো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। এটি শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা ৭ মার্চের ভাষণ। ৭ মার্চের ভাষণেই মূলত স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

১৯৭২ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।’ ‘আপনার দুর্বলতা কোথায়?’, ‘আমি আমার জনগণকে অনেক বেশি ভালোবাসি।’ যে মানুষ এমন করে বলতে পারেন, তিনি যুগে যুগে জন্মান না। আর জন্মান না বলেই নিউজউইক সাময়িকী তাঁকে উপাধি দেয় ‘রাজনীতির কবি’। বিবিসি জরিপে তিনি হন ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’।

বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। তাঁর দৃপ্ত আহ্বানে অস্ত্রহীন মানুষ যুদ্ধে নেমেছে।

একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন রচিত হয় ৭ মার্চের ভাষণে। জাতি প্রস্তুত হয় চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য। স্বাধীনতার দুর্নিবার স্বপ্ন বাঙালিকে নিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত মুক্তির লক্ষ্যে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের নির্দেশনার পথ ধরেই হয় দীর্ঘ ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। লাখো প্রাণের বিনিময়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় নতুন একটি দেশ। শহীদের আত্মদান, বীরের রক্তস্রোত, আর লাখো মা-বোনের জীবন ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি অর্জন করে বাংলাদেশ নামের একটি মানচিত্র।

আরও পড়ুন