স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় বিভোর জনপদের মুক্তির বার্তা

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ছবি অবলম্বনে কোলাজ
শাকিব হাসান

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ চেতনায় উদ্দীপ্ত বাঙালির ইতিহাসের এক অনন্য দিন। সেই ব্রিটিশ-ভারত থকে শুরু। তারপর একাত্তরের বিজয় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রায় তিন যুগের আন্দোলন। চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। আর এ লক্ষ্য অর্জনের পথ দেখিয়েছে ৭ মার্চের ভাষণ। মুক্তিপাগল মানুষের মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনে দিয়েছিল এ ভাষণ। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের বিরল নেতা, যিনি একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে দেশের প্রায় সব মানুষকে এক মিছিলে দাঁড় করিয়েছিলেন। একটি অসহযোগ আন্দোলনকে রূপান্তর করেছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। দীর্ঘ বছরের শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছিল। রচনা করেছিলেন এক মহাকাব্য। পৃথিবীর ইতিহাসে এর তুলনা নেই। ৭ মার্চের ভাষণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবিকতা আর অসাম্প্রদায়িকতার এক অনন্য ঘোষণা।

৭ মার্চ হঠাৎ করে আসেনি। এটা ছিল এক দীর্ঘ ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমি। মার্চের শুরু থেকেই রাজপথ উত্তাল হতে থাকে। এরই মধ্যে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। জাতীয় সংগীত নির্বাচন করা হয়। অপেক্ষা ছিল শুধু বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার।

কেবল এ দেশের মানুষ না, পৃথিবীর গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক বিশ্বও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অপেক্ষায় ছিল। তাদের কৌতূহল ছিল বঙ্গবন্ধু কী বলেন। কারণ, তারা ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ শাসন থেকে বাঙালি জনপদে পাকিস্তানি শাসন ছিল ভয়াবহ। বহির্বিশ্ব বুঝতে পেরেছিল, বঙ্গবন্ধু আর পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকবেন না। এত দিন তিনি দেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এবার হয়তো সেই স্বপ্নপূরণের দিকেই এগোচ্ছেন। তাই বিশ্বনেতারা ও গণমাধ্যম ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বিষয় নিশ্চিত ছিল। এটা তাদের কিছুটা ভাবিয়েও তুলেছিল। তাই ৫ মার্চ লন্ডনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’, ‘সানডে টাইমস, ‘দ্য অবজারভার’ আর ৬ মার্চ ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ৭ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার আভাস দেওয়া হয়েছিল। ৬ মার্চ তো ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ ছাপিয়ে দেয় যে ‘শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল (৭ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন।’

এদিকে শাহবাগ বেতার কেন্দ্র থেকে সরাসরি এ ভাষণ প্রচারের সব আয়োজন করা হয়েছিল। একদম শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানি সামরিক সরকার এটা প্রচার করতে দেয়নি। কিন্তু গণজাগরণের চাপে তারা নতি স্বীকার করেছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৮ মার্চ এ ভাষণ প্রচার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল এ দেশের মানুষের স্বপ্ন, আবেগ, আকাঙ্ক্ষা। পৃথিবীতে আর কোনো ভাষণ এতবার শোনা হয়নি, যতবার শোনা হয়েছে ৭ মার্চের ভাষণ।

এ ভাষণ থেকে অনুপ্রেরণা পাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মানুষ। ভবিষ্যতে যারা দেশের নেতৃত্ব দেবে, তারা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ দ্বারা উজ্জীবিত হবে। বঙ্গবন্ধুও বলে দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেদিন রেসকোর্স মাঠের সমবেত জনতা জাতির জনকের ভাষণ বুকে ধারণ করে ঘরে ফিরে। তারা বুঝে গেল আর পেছনে ফেরার সময় নেই। এবার হিসাব মেলাতে হবে যুদ্ধের ময়দানে।

৭ মার্চ সকাল থেকেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে নেতাদের ভিড়। বেলা দুটার দিকে আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদসহ নেতা-কর্মীদের নিয়ে জনসভার দিকে রওনা হলেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন সকাল থেকেই রাজধানী পরিণত হতে থাকে মিছিলের নগরীতে। বিরতিহীন গণসংগীত চলছিল। অবশেষে শেষ হলো লক্ষ মানুষের অপেক্ষার প্রহর। অতঃপর বঙ্গবন্ধু জনতার মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। মঞ্চে তিনি একাই ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা–ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’

লাঠি–ফেস্টুনসহ লাখো মানুষের স্লোগানে মুখরিত ছিল জনসভা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় ছিল পিনপতন নীরবতা। ভাষণ শেষে আবার স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাস্তাগুলো। বক্তৃতাজুড়ে ছিল আসন্ন জনযুদ্ধের রণকৌশল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। আবার তিনি এমনভাবে ভাষণটি দিয়েছেন যে কেউ তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলতে পারেনি। ১০ লক্ষাধিক নিরস্ত্র মুক্তিকামী মানুষের সামনে পৃথিবীর আর কোনো নেতা ভাষণ দেননি।

৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক অমূল্য সম্পদ। স্বাধীনতা–উত্তর একটি বিশাল প্রজন্ম রয়েছে। যারা ভাষণটি সরাসরি দেখতে বা শুনতে পায়নি। কিন্তু এখন তারা এই ভাষণ শুনে নতুন করে জেগে উঠবে। প্রেরণা পাবে এগিয়ে যাওয়ার। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির নেই যে একজন নেতা একটি জাতিকে একটি দাবিতে জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন।

বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যম এ ভাষণকে এক যুগান্তকারী দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ হিসেবে মূল্যায়ন করছে। বিশ্বনেতৃত্ব ও গণমাধ্যমের কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল ভৌগোলিক স্বাধীনতার পাশাপাশি এ দেশের মানুষের মুক্তির দলিলও। ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে পৃথিবীর গণমাধ্যম সেদিন যা বলেছিল:

রয়টার্স: ১৯৭১ সালে রয়টার্স তার প্রতিবেদনে বলে, ‘বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম আরেকটি পরিকল্পিত ও বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা ও দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

বিবিসি: একাত্তরে-বিবিসি মন্তব্য করেছে, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে জন আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনীয় ভাষণটি। যেখানে তিনি একাধারে বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়ক।’

টাইম ম্যাগাজিন: টাইম ম্যাগাজিনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, ‘শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ওই ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল।’

এএফপি: এএফপি তার বিশ্লেষণে বলেছে, ‘৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওই দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’

ওয়াশিংটন পোস্ট: ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছে ওই ভাষণের আলোকে।’

নিউজউইক: ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ দিকে দেশে শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। সে সময় আমেরিকার বিশ্ব বিখ্যাত সাময়িকী ছিল ‘নিউজউইক’ তাদের প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ ‘দ্য পোয়েট অব পলিটিকস’ বলে অভিহিত করে। নিউজউইকে বলা হয়েছে, ৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান।’

আনন্দবাজার পত্রিকা: ১৯৭২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘উত্তাল জনস্রোতের মাঝে, এ রকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দিকনির্দেশনামূলক ভাষণই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে। দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা।’

আড়াই হাজার বছরে সেরা ভাষণের তালিকায়: জ্যাকব ফ্রানজ ফিল্ড কানাডার একজন অধ্যাপক, লেখক, ইতিহাসবিদ। তিনি বিশ্বজুড়ে সেরা ভাষণ নিয়ে একটি বই সংকলন করেছেন। বইটির নাম ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস-দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টরি।’ এ বইয়ে আছে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার বছরের সেরা ভাষণগুলো। এটি ২২৩ পৃষ্ঠার একটি বই। এই বইয়ে ‘দ্য স্ট্রাগল দিজ টাইম ইজ দ্য স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স’ শিরোনামে একটি ভাষণ রয়েছে। ভাষণটি হলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলের ভাষণ দিয়ে শুরু হয়েছে। আর শেষ ভাষণটি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগ্যানের। বইটির ২০১ পৃষ্ঠায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্য থেকে বইটি প্রকাশিত হয়।

ইউনেসকো: ইউনেসকো ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার’ পরিচালনা করে। এটি হলো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্যের একটি তালিকা। ইউনেসকোর উপদেষ্টা কমিটি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিকে দুই বছর পর্যালোচনা করে। তারপর এ ভাষণকে স্বীকৃতি দেয়। ৭ মার্চের ভাষণসহ মোট ৭৮টি দলিলকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইউনেসকো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ৩০ অক্টোবর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ এ ধরনের দলিল স্থান পায়। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করাই এর উদ্দেশ্য। ইউনেসকোর স্বীকৃতি শুধু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকেই সম্মান এনে দেয়নি, সমগ্র দেশ ও জাতিকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

এ ভাষণ এখন আর কেবল বাংলার মানুষের একার নয়, এটা এখন সারা পৃথিবীর অধিকারহারা মানুষের দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় বিভোর জনপদের মুক্তির বার্তা।

আশফাকুজ্জামান: কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংগঠক