তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বমানব

রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ৭ মার্চ ১৯৭১
ছবি: সংগৃহীত

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর দীর্ঘ ২৩ বছরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন হয়। পূর্ব পাকিস্তানে মোট ১৬৯টি আসন। এর মধ্যে ১৬৭ আসন পেয়ে ইতিহাসের স্মরণীয় জয় অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। কিন্তু দিন গড়িয়ে মাস যায়। কোনোভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে না পাকিস্তান সরকার। কেবলই ষড়যন্ত্র আর ষড়যন্ত্র। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন।

এরই মধ্যে দ্রুত নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৫ ফেব্রুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো অধিবেশনে না আসার কথা বলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হঠাৎ মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করে দেন। এদিকে ভুট্টো বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তা হবে ‘ডিকটেটরশিপ অব দ্য মেজরিটি’—সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্ব। প্রতিবাদে ২৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন করে। ভুট্টো সাহেবের ইচ্ছা পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক, ডিকটেটরশিপ অব দ্য মাইনরিটি। বাংলার মানুষ এটা মেনে নেবে না।’ এমন পরিস্থিতিতে ১ মার্চ ইয়াহিয়া ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। বাংলার মানুষ ফেটে পড়ে রোষানলে।

সেদিন প্রায় সবাই রাজপথে নেমে আসে। এক কণ্ঠে স্লোগান দেয়—

‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৩ বছর যাবৎ একই ষড়যন্ত্র করছেন, আর ষড়যন্ত্র করবেন না।’

পূর্ব বাংলায় আগুন জ্বলে ওঠে। সারা দেশে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণের সৃষ্টি হয়। এমনই এক কঠিন বাস্তবতাকে সামনে রেখে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণের কথা বলেন। সেদিন ভোর থেকেই লাখ লাখ মানুষ জড়ো হতে থাকেন রেসকোর্স ময়দানে। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় বিভোর সবাই। ৭ মার্চ। বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করেন। শেষ করেন বেলা ৩টা ৩ মিনিটে। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণে ছিল এ দেশের মানুষের মুক্তির ডাক। স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিত ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যত দিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, তত দিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ মুক্তিকামী মানুষের মনে বেঁচে থাকবে। ভাষণটি শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’

৭ মার্চের ভাষণের ঐশ্বর্য নিয়ে রচিত হয়েছে কত গল্প, কবিতা, উপন্যাস। বাংলা থেকে কোনো দিন শেষ হয়ে যাবে না এ ভাষণের আবেদন।

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শন ম্যাকব্রাইড ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন মানুষের মুক্তি। সাম্য নিশ্চিতকরণ ও সম্পদের বৈষম্য দূর করা। এর মধ্যেই নিহিত স্বাধীনতার আসল সার্থকতা। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চের ভাষণে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ
ছবি : সংগৃহীত

পাঁচ দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিশালী গণমাধ্যম, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গবেষক, বাংলাদেশের জাতির পিতা ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ’কে বিশ্বের অন্যতম ভাষণ মনে করেছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ হলো স্বাধনতার মূল দলিল।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন আব্রাহাম লিংকন। সময়টা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। তিনি ছিলেন রিপাবলিকান পার্টির প্রথম প্রেসিডেন্ট। ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি দাসপ্রথা বিলুপ্ত করেন। কিন্তু এটা নিয়ে আমেরিকানদের মধ্যে চরম বিরোধ দেখা দেয়। এ বিরোধ থেকে পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গে গৃহযুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধে প্রায় আট হাজার মানুষের প্রাণ যায়। ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গৃহযুদ্ধে নিহতদের স্মরণে এক ভাষণ দেন। এটি ছিল মাত্র দুই মিনিটের ২৭২ শব্দের দুনিয়া কাঁপানো এক ভাষণ। একে মনে করা হয় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বিশ্বের ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ বিদগ্ধজনেরা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দারুণভাবে পর্যালোচনা করেছেন। তাঁরা মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল সময়ের সেরা বুদ্ধিদীপ্ত ও কৌশলী। আব্রাহাম লিংকনের ভাষণকে ছাপিয়ে গেছে এ ভাষণ। কারণ, আব্রাহাম লিংকনের ভাষণ ছিল লিখিত। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল সম্পূর্ণ অলিখিত। প্রচণ্ড চাপের মধ্যে তাঁকে এ ভাষণ দিতে হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি : সংগৃহীত

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন তিনি যেন এমন কোনো পদক্ষেপ না নেন, যাতে ফিরে আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন, তিনি হুমকি দেন যে মার্কিন সরকার পাকিস্তান ভাঙা সহ্য করবে না।

রেসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড লিখেছেন, ‘রোববার ৭ মার্চ প্রদত্ত মুজিবের ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন, তার চেয়ে লক্ষণীয় হলো তিনি কী বলেননি। কেউ কেউ আশঙ্কা করছিলেন, আবার কেউ কেউ আশা করেছিলেন যে তিনি বাংলাদেশকে সরাসরি স্বাধীন ঘোষণা করবেন। এর বদলে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান তিনি জানালেন।’ আর্চার ব্লাড ঢাকায় অবস্থান করে পরিস্থিতির গুরুত্ব ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মর্মার্থ ও তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু নিজে ও তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বনেতাদের কাছে ছিল এক বিস্ময়। পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা, অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা।’

সময় গড়িয়েছে পঞ্চাশ বছর। তখন কি কেউ ভেবেছিল ১৮ মিনিটের একটি ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাস হবে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেসকো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

‘কল–রেডী’ মাইকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই পৃথিবীবিখ্যাত ভাষণ।
ছবি: সংগৃহীত

অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক।…তাঁর সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীও স্বীকার করবে।’

১৯৭২ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।’ ‘আপনার দুর্বলতা কোথায়?’ ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ যে মানুষ এমন করে বলতে পারেন, তিনি যুগে যুগে জন্মান না। আর জন্মান না বলেই নিউজউইক সাময়িকী তাঁকে উপাধি দেয় ‘দ্য পয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’। বিবিসি জরিপে তিনি হন, ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’।

বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। এ ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত আহ্বানে অস্ত্রহীন মানুষ যুদ্ধে নেমেছে। জাতির জনকের রাজনৈতিক জীবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে আন্দোলন-সংগ্রামে।

বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গেলে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর কথা মনে পড়বে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত ও অবিচলতা নিয়ে বলতে গিয়ে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।’ তিনি আরও বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি সংগৃহীত

অবিভক্ত ভারত থেকে পাকিস্তান। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ। দীর্ঘ ৩৮ বছর তিনি আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। রুখে দাঁড়িয়েছেন শোষণ, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আজীবন থেকেছেন আপসহীন। মৃত্যু পর্যন্ত জীবন উৎসর্গ করেছেন অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য।

যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোশেফ মার্শাল টিটো বলেছিলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোনো রকম বৈধতা নেই। পূর্ব পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ।’

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘...জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। জনগণ সে অধিকার আমাকে দেয় নাই।…আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’

কিউবান বিপ্লবী নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফিদেল কাস্ত্রো। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর সাহস, ধৈর্য ও আদর্শকে তুলনা করেছিলেন হিমালয়ের সঙ্গে। তাই তিনি হিমালয় না দেখে বঙ্গবন্ধুকে দেখলেই হিমালয়কে দেখা হয় বলে মনে করেছেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্বনন্দিত অবিসংবাদিত নেতা। হিমালয়ের মতো বিশাল মানুষটিকে ছোটবেলায় মা–বাবা আদর করে ডাকতেন খোকা।

নদীবিধৌত বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেও তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বমানব। উপমহাদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদের একজন।

আশফাকুজ্জামন: কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংগঠক