১৪১২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাস। চারদিকে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। রবিউলের স্ত্রী সুফিয়া বাবার বাড়ি গিয়েছেন। রবিউলকেও যেতে বলেছেন ঘটা করে। মা রশিদা বেগম ছেলেকে বললেন, ‘বাবা, এই বৃষ্টিবাদলার দিনে ক্যামনে যাবি?
‘মা, চিন্তা কইরো না, বৃষ্টি কইমা যাইব।’
‘সাবধানে যাস।’
‘আচ্ছা, মা।’
পড়ন্ত বিকেলে সূর্য ডুববে—এমন মুহূর্ত। আকাশ লালচে দেখাচ্ছে সূর্যের এপারে মেঘের ঘনঘটায়। রবিউল ফুলহাতা গ্রামীণ চেক শার্ট পরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সাইকেলটা ওর বাবাও চালায়। মধ্যচর থেকে বের হওয়ার পর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ভাবকী ব্রিজে উঠতেই পেছন থেকে ঘোড়ার পায়ের শব্দ কানে আসছে। সাইকেল থামিয়ে পেছনে তাকাল। কোথাও কেউ নেই। কোনো জনমানুষ নেই। সুনসান নীরবতা। আবার সাইকেল চালাতে শুরু করল। পেছন থেকে পুনরায় একই আওয়াজ। আবার সাইকেল থামাল। কোনো সাড়াশব্দ নেই।
এবার তুফানের গতিতে সাইকেল ছোটাতে থাকে রবিউল। ছুটছে তো ছুটছেই, ঘেমে একাকার। ভাবকী বাজারেও সে থামল না। যত দ্রুত সম্ভব কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করল। মানকি বাজারে রবিউল দাঁড়াল। ছাহেদ আলীর পানের দোকানের সামনে। ছাহেদকে সে চেনে, দুজনের ভীষণ সখ্য। রবিউল ভাবকী ব্রিজের কাহিনি ওকে জানায়। পরে ছাহেদ তাকে দেবেরছড়া পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চাইল। রবিউলের সাইকেলের পেছনে উঠল সে। ছাহেদকে দেবেরছড়া নামিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল রবিউল।
গ্রামের নাম ছবিলাপুর, মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নে। বিএনএস বাজারের কাছ দিয়ে যেতে হয় ছবিলাপুর। বাজারের কাছেই কুকার ব্রিজ। কুকা নামের একটা লোককে গ্রামবাসী কিংবা গ্রামের বাইরের কেউ হত্যা করে এখানকার মাটিতে পুঁতে রেখেছিল। সেখান থেকেই নামকরণ। ব্রিজটি ভেঙে যাওয়ায় পাশের মাটির রাস্তা দিয়ে যেতে হচ্ছিল। সামনে যেতেই কুকার কথা মনে পড়ল। এই বুঝি লোকটার আত্মা এসে ভয় দেখাবে!
হঠাৎ সাইকেল থেমে যায় রবিউলের, মুখ শুকিয়ে যায়। জিনে ধরেনি তো! সাইকেল এগোচ্ছে না। রবিউল তাকিয়ে আছে ঝোপঝাড়ের দিকে। এখানেই বুঝি পুঁতেছিল কুকাকে। হঠাৎ দুটি চোখ আবিষ্কার করে সে। তার দিকে তেড়ে আসছে। আতঙ্কিত হয়ে যায়। উত্তেজনা ছাপিয়ে সে শুনতে পায় ‘ম্যাও ম্যাও’ শব্দ। ভয় কেটে যায়। সাইকেলে এগোতে থাকে কাঁচা রাস্তা ধরে। মনে পড়ল, সে কোনো বাজারে থামেনি আজ; এতক্ষণ একটুও খেয়াল ছিল না। থাকবে কী করে? যা হলো আজ!
ছবিলাপুর পৌঁছাল অবশেষে। সুফিয়া স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে, ‘এত রাত করলা ক্যান? আগেভাগে রওনা দিতা।’
‘আর কইয়ো না। বাড়ির কাজবাজ শেষ কইরা তারপর আইলাম।’
রাস্তায় ঘটে যাওয়া কাহিনি না বলাই শ্রেয় মনে করল সে। এমনিতেই মেয়ে মানুষ, ভয় পেলে আরেক সমস্যা।
রবিউলের চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে। তা ছাড়া বাড়িতে পেঁয়াজ আর আলু শেষ হয়ে গেছে। আজ শনিবার, কাহেতপাড়া বাজারের দিন। বেশি রাগ করলে হাঁটে কিছু পাওয়া যাবে না। তড়িঘড়ি করে শার্ট না পাল্টিয়েই ঘর্মাক্ত অবস্থায় বেরিয়ে পড়ল।
বাজারে গিয়ে আলু আর পেঁয়াজ কিনে সাইকেলে রাখল। তারপর চায়ের দোকানে গেল। রেডিওতে বাজছে রবীন্দ্রসংগীত।
‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না?
কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে?
তোমারে দেখিতে দেয় না।’
চা শেষ করে যখনই রওনা দেবে বাড়ির উদ্দেশে, অমনি বৃষ্টি নামল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, থামার কোনো লক্ষণ নেই।
আকাশে হলদেটে আভার পূর্ণচন্দ্র। সঙ্গে রাজ্যের উথাল–পাতাল নক্ষত্রদের পুনর্মিলনী। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ায় আর চোখে পড়ছে না। খুব তীক্ষ্ণভাবে নজর রাখলে মনে হয়, সেথায় চাঁদের বুড়ি ক্রমাগত সুতা কাটছে। ছেলেবেলায় কত কিসিমের লোকজনের কাছ থেকে সত্য-অসত্য, রূপকথা-পেটফাটা হাসি, ভূতপ্রেত, বিষণ্নতায় ভরা কিচ্ছাকাহিনি রবিউল শুনেছে, তার ইয়ত্তা নেই। হঠাৎ দাদির কথা মনে পড়ে। জীবদ্দশায় নাতি-নাতনিদের সঙ্গে হেসেখেলে আনন্দে অতিবাহিত করেছেন সময়। কিন্তু মৃত্যুশয্যায় অনেক পাথরচাপা কষ্ট মুখ বুজে সয়েছেন। হঠাৎ একদিন সবাই খেয়াল করল, জমিরন বেগম আর আগের মতো নেই। আগের মতো আর গল্পের আসরে দেখা যায় না। দিন কাটে নিস্তব্ধতায়-নিঃসঙ্গতায়। খেতে পারেন না ঠিকঠাক, চিনতে পারেন না কাউকে, শুধু অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন মুখাবয়বের দিকে। আত্মীয়স্বজন এসে দেখে যান তাঁকে। সবাই জিজ্ঞেস করেন, ‘আমারে চিনছেন? কন তো, আমি কেরা? মনে পড়ে?’ পরে বলতেন, ‘আমরা আয়লে এই মানুষটা কত কিছু জিগাইতেন, আদর-আপ্যায়ন করতেন। আর এখন কিছুই কইতে পারতাছেন না। হায়রে জীবন!’
অনেক প্রতীক্ষার পরও থামল না বৃষ্টি। রবিউল বেরিয়ে পড়ল বৃষ্টিজল গায়ে মেখেই। জালালের বাড়ির কাছে হেঁটে যেতেই মনে পড়ল, দুই মাস আগে বাদল নামের একজন গলায় রশি দিয়ে রাস্তার পাশে আত্নহত্যা করেছে। সে ভয় পাচ্ছে এখান দিয়ে যেতে। হঠাৎ দেখল, দূরে সাদা শাড়ি পরে একজন বসে আছে চুপচাপ, নড়ছে না। রবিউল ভয় পেয়ে গেল। একই জায়গায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। নাড়াচাড়া করছে না। তারপর সাহস করে কাছে গিয়ে দেখে, শুভ্র শাড়ি পরা কেউ নেই। সাদা অবয়বটি দুটি কলাগাছের মধ্য দিয়ে আসা জোছনার আলো!
বন্ধু, জামালপুর বন্ধুসভা