রুম নম্বর ২১৩

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর পুরোনো একটি হাসপাতাল ‘সেন্ট অ্যাগাথা মেমোরিয়াল’ বহু বছর ধরে বন্ধ। একসময় এখানে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা হতো। এখন জায়গাটা সরকারি মালিকানায়, তবে কার্যত পরিত্যক্ত। চারদিকে ঘাস, ঘন জঙ্গল আর আগাছা। ভুতুড়ে এক পরিবেশ।

রাত ২টা ৪৭ মিনিট। একজন অচেনা মানুষ ভেতরে ঢুকেছে। নাম আবির। পেশায় ফরেনসিক অ্যানালিস্ট। তবে এখানে সে এসেছে একটা অব দ্য রেকর্ড মিশনে। গত দুই মাসে তিনজন সরকারি কর্মকর্তা আত্মহত্যা করেছেন। সবার শরীরে পাওয়া গেছে একই রকম রক্তজমাট দাগ, মস্তিষ্কে গোপন ইনপ্লান্টের চিহ্ন, আর কানে একটা নির্দিষ্ট সিগন্যালের ছাপ। তাদের মধ্যে একমাত্র মিল হলো—প্রত্যেকেই ১৫ বছর আগে সেন্ট অ্যাগাথাতে এক গোপন গবেষণায় যুক্ত ছিলেন, প্রজেক্ট রেডমাইন্ড।

আবির যখন বাক্সটা খুলল, তখনই চারপাশ কেঁপে উঠল হালকা। মনে হলো, ঘরের বাতি একটু কমে এসেছে।

আবির সেই গবেষণার তথ্য পেতে এসেছে। কিন্তু সরকারি কোনো অনুমতি নেই, সে একা। হাতে শুধু একটা গ্লাস-পেনটাচ স্ক্যানার, একটা রিভলবার ও পুরোনো মানচিত্র। হাসপাতালের ভেতরে বাতাস ভারী, যেন চিৎকার জমে আছে দেয়ালের মধ্যে। পেছনের দরজা খুলে ঢুকতেই তার হাতে থাকা স্ক্যানার এক অদ্ভুত শব্দ করে ওঠে।

সিগন্যাল একটিভেটেড। ফ্রিকোয়েন্সি মিলে গেছে। ১৩.৭ মেগাহার্টজ। আবির থমকে দাঁড়ায়। ১৩.৭ মেগাহার্টজ এই সিগন্যালটাই পাওয়া গিয়েছিল মৃতদের কানে। আবির বুঝে যায় সে ঠিক জায়গায় এসেছে। হাসপাতালের নিচতলার করিডর পেরিয়ে সে নামে বেজমেন্টে। সব দরজা তালাবদ্ধ। কিন্তু একটাই খোলা, ২১৩ নম্বর রুম। রুমটা অদ্ভুতভাবে পরিষ্কার। যেন এখানে এখনো কেউ থাকে। মাঝখানে একটা পুরোনো ডেস্ক। ডেস্কের ওপর পড়ে আছে কিছু ফাইল, ছবি আর একটি ছোট কালো বাক্স। বাক্সে কোনো লক নেই, কিন্তু খোলার আগে সে ফাইলগুলো দেখতে শুরু করে। ফাইলের ওপর বড় করে লেখা,
‘রেডমাইন্ড সাইকো-সিগন্যাল ট্রায়াল রিপোর্ট- কোড: MNX-13’

আবিরের চোখ বড় হয়ে ওঠে। রিপোর্টে লেখা, এই ঘরে একসময় ১৭ জন রোগীর ওপর একধরনের ‘মনো-সিগন্যাল ট্রান্সফার’ এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয়েছিল। যার মাধ্যমে মানসিক অবস্থা অন্য মানুষকে ট্রান্সফার করা যেত। তাদের ভয়, দুঃস্বপ্ন, কিংবা শারীরিক যন্ত্রণাও! সিস্টেমটি ছিল ফ্রিকোয়েন্সি নির্ভর এবং সফল হলে শিকার ব্যক্তির মস্তিষ্কে সাইকো-রিফ্লেক্টর ইনপ্ল্যান্ট সক্রিয় হয়ে উঠত নিজের মৃত্যু পর্যন্ত।

আবির যখন বাক্সটা খুলল, তখনই চারপাশ কেঁপে উঠল হালকা। মনে হলো, ঘরের বাতি একটু কমে এসেছে।
বাক্সের ভেতরে ছিল একটা পুরোনো ক্যাসেট টেপ, একটা ইনপ্ল্যান্ট ডিভাইস আর একটা ছোট রক্তমাখা নোট। নোটটায় লেখা, ‘যদি তুমি শোনো, তুমি আর তুমি থেকো না। MNX-13 শেষবার চালু হয়েছিল ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর। আজ আবার হবে।’

আবির টেপটা চালায়। ক্যাসেটে ভেসে আসে এক নারীর কণ্ঠ, ‘আমি ড. তাহসিনা আরা। রেডমাইন্ডের মুখ্য গবেষক। আমার ভেতরে এখন তেরো জন মানুষ বাস করে। তাদের কান্না, চিৎকার, মৃত্যু সবই আমি অনুভব করি। এখন আমি আর মানুষ নই। আমি এক চলমান ট্রান্সমিটার, ভয়ের তরঙ্গ ছড়াই। নিঃশব্দে, অবিরাম।’
তারপর হঠাৎ এক জোরালো শ্বাস, আর একটা শব্দ- ‘পালাও’।

ঠিক ওই মুহূর্তে রুমের দরজা ধাক্কা খায়। আবির পেছনে ঘোরে। কিছুই নেই। তখন স্ক্যানারে শব্দ বাড়তে থাকে। সিগন্যাল মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। আবির বুঝতে পারে, এই জায়গা এখনো লাইভ। হয়তো কেউ আছে এখানেই, হয়তো অদৃশ্য কিছু। সে দ্রুত বেরিয়ে যেতে চায়, কিন্তু বেজমেন্টের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই এক পর্দা-সদৃশ ছবি ফুটে ওঠে দেয়ালে, ড. তাহসিনা বসে আছেন। যেন লাইভ ভিডিও। কিন্তু এই ছবি ১৫ বছরের পুরোনো! তিনি তাকিয়ে আছেন ক্যামেরায়। হঠাৎই মুখ ঘুরিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমি আমাদের শেষ পর্যবেক্ষক, আবির।’

সে স্তব্ধ। সে কখনো বলেনি তার নাম। কোনোভাবে সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে। তখনই শুরু হয় অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখছে অচেনা লোকেরা মরে যাচ্ছে।

পাঁচ দিন পর, আবির এক পুরোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যায়। ড. আরমান রশীদ, যিনি রেডমাইন্ড থেকে আগেই পদত্যাগ করেছিলেন। ড. আরমান এক গ্লাস পানি রেখে বলেন, ‘তোমার মস্তিষ্ক এখন MNX-13 ট্রান্সমিট করছে। যাকে সামনে পাবে, তাকেই সংক্রমিত করবে।’
আবির শিউরে ওঠে। ‘আমি কী করব?’
‘শুধু একটাই উপায়, ‘ফিডব্যাক লুপ তৈরি করো। নিজের ভয়কে নিজের ওপর ফেরত দাও।’  

আবির তখন নিজেই তৈরি করে একটি রিভার্স সিগন্যাল- ১৩.৭ মেগাহার্টজের বিপরীত তরঙ্গ। সে আবার যায় হাসপাতালের ২১৩ নম্বর রুমে। এক হাতে রিভলবার, অন্য হাতে সিগন্যাল ট্রান্সমিটার। ঘরে ঢুকতেই সব বাতি নিভে যায়। তার চোখে ভেসে ওঠে সেই ১৭ জনের মুখ, একসঙ্গে চিৎকার করছে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে।

সে নিজের ভয়কে গ্রহণ করে। চিৎকার করে সিগন্যাল চালায়। দরজা খুলে যায়।

পরদিন সকাল ১০টা, জাতীয় সংবাদে শিরোনাম ‘রেডমাইন্ড স্ক্যান্ডাল ফাঁস। শতাধিক মানুষকে গোপন মানসিক গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে। জীবিত পাওয়া গেছে একজন মাত্র—আবির, যিনি সবকিছু প্রকাশ করেছেন।’

বন্ধু, গাজীপুর বন্ধুসভা