সে তাকে থামিয়ে দেয়। ‘তুই এসবে জড়িয়ে পড়ছিস কেন? অফিসে কথা উঠছে। তোর নামে রিপোর্ট গেছে। ওরা তোকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে...
এক.
রাত ১১টা ৪৭ মিনিট। নাহিয়ান হঠাৎ করে মুঠোফোন বন্ধ করে জানালার পাশে দাঁড়াল। নিচে একটা কালো মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে। হেডলাইট নেভানো, ইঞ্জিন বন্ধ। পাঁচ মিনিট ধরে একটুও নড়ছে না। সে জানে, এই শহরে কেউ নিছক দাঁড়িয়ে থাকে না। বিশেষ করে, রাত বাড়লে।
নাহিয়ান পেশায় সাংবাদিক। অনলাইন পত্রিকা প্রতিস্বরের ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার। এক মাস ধরে সে কাজ করছিল ‘অব দ্য রেকর্ড’ নামে একটি গোপন তদন্তের ওপর। একটি সিরিজ গুম, যা সরকার স্বীকার করে না, কিন্তু পরিবারগুলো দিনে দিনে ভেঙে পড়ছে। সর্বশেষ তদন্ত করেছিল রাজশাহীর এক ছাত্রনেতা সোহেল মজুমদারের গুম নিয়ে। ফেসবুকে সোহেল সরকারের নীতির সমালোচনা করেছিল। ঠিক দুই দিন পর থেকেই সে নিখোঁজ। সিসিটিভিতে দেখা যায়, কালো পোশাকধারী চারজন লোক তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির নম্বর প্লেট ছিল না। ঠিক যেমন আজকের গাড়িটা। রাত ১টা ১০ মিনিট।
নাহিয়ান জানে আর দেরি করলে হবে না। ফোল্ডারে থাকা সব ডকুমেন্ট এক জায়গায় গুছিয়ে ফেলে, একটা ইউএসবি পেনড্রাইভ বের করে ফোল্ডারের নিচে লুকিয়ে রাখে। তারপর ল্যাপটপে একটি ই–মেইল টাইপ করে, ‘এই তদন্ত ফাইলটি প্রকাশ করবেন, যদি আমি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যোগাযোগ না করি। আমার পেনড্রাইভে সব আছে। আমার সর্বশেষ অবস্থান: মিরপুর ১, ব্লক-ডি, রোড–১৪, ১৭ আগস্ট ২০২৪। আমি জানি, তারা আসছে। হয়তো আজ রাতেই। কিন্তু সত্য চাপা পড়ে না।’
সকালে নাহিয়ানের মা চায়ের কাপ হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু ছেলের দরজা খোলা, বিছানা খালি, ফোন বন্ধ, ল্যাপটপ গায়েব। ঘরের মেঝেতে একটা কাগজ পড়ে ছিল। সেখানে লেখা, ‘অবাধ্যদের জায়গা অন্ধকারে’।
দুই.
সকাল থেকেই মিরার বুকের ভেতর চাপা ঘূর্ণিঝড়। নাহিয়ান গত রাতে কল ধরেনি। আজ সকালেও অফিসে আসেনি। খোঁজ নেই, কোথাও কোনো খবর নেই। সে যদি কোথাও যেত, তাকে জানিয়ে যেত। সে কখনো এমন করে না, মনকে বোঝাতে বোঝাতে ছুটে যায় নাহিয়ানের বাসায়। ঘরের দরজা খুলে দেন মা। চোখ লাল, কণ্ঠ কাঁপছে। মিরা বলে, ‘মা, নাহিয়ান কোথায়?’ মা বলেন, ‘রাতভর ঘরে ছিল না। ফোন বন্ধ। আমিও জানি না।’
মিরা কোনো কথা না বলে সোজা ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতর। বিছানা অগোছালো, জানালার পাশে কাপড় ঝোলানো, কিন্তু টেবিল ফাঁকা। ল্যাপটপ নেই। মুঠোফোন নেই। একটা কাগজ খুঁজে পায় সে, বিছানার নিচে চাপা পড়ে ছিল। তাতে লেখা, ‘অবাধ্যদের জায়গা অন্ধকারে’।
মিরার গা শিউরে ওঠে। কাগজটা তুলে সে ঠান্ডা মাথায় চারপাশ খোঁজে। বইয়ের র্যাক, কাপড়ের ভাঁজ, দেয়ালের পেছনে, এমনকি কার্পেট তুলেও খুঁজে দেখে। শেষে একটা ছোট্ট পেনড্রাইভ বেরিয়ে আসে টেবিলের কাঠের ফাঁকের নিচে লুকোনো অবস্থায়।
দুই দিন আগে মিরাকে নাহিয়ান বলেছিল, ‘আমি একটা বড় কেসের খোঁজে আছি। যদি আমি হারিয়ে যাই, জানবে এটা দুর্ঘটনা নয়। একটা ফাইল তোমার কাছে পৌঁছাবে।’ তখনো মিরা বিশ্বাস করেনি। এখন সে ভয় পায়, এ ফাইলটাই হয়তো নাহিয়ানের শেষ চিহ্ন। অফিসে ফিরে পেনড্রাইভটা কম্পিউটারে ঢোকাতেই খুলে যায় একটি ফোল্ডার। ফোল্ডারের ভেতর সিসিটিভি ফুটেজ (নিখোঁজ ছাত্রনেতা সোহেলের)। অডিও রেকর্ড, এক সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তার। একটি ডকুমেন্ট, ‘অন্ধকার পরিকল্পনা-১৭’। আর একটি ভিডিও, শিরোনাম, ‘তাদের চোখে অন্ধকার’।
মিরা ঘাবড়ে যায়। এত বড় তথ্য! যদি এগুলো ফাঁস হয়, রাষ্ট্র কেঁপে উঠবে। ঠিক তখনই ফোন আসে, ‘তুমি মিরা? নাহিয়ানের সহকর্মী? তাকে যদি বাঁচাতে চাও, তাহলে তুমি চুপ থাকো। অন্যথায়, তুমি হবে পরবর্তী শিকার।’ কল কেটে যায়।
মিরা জানে, এখন আর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। নাহিয়ান যদি হারিয়েই যায়, তবে তার সত্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে। গোপনে, নিঃশব্দে তার যুদ্ধ শুরু।
তিন.
তিন দিন পর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বেলা ২টা ১৩। দোতলার ঘরের জানালাটা খোলা। বাতাসে কাঁপছে একটা সাদা ওড়না। নিচে উঠানে বসে আছেন এক বৃদ্ধা, মুখে গভীর শূন্যতা। তাঁর ছেলের নাম সোহেল মজুমদার। দুই মাস আগে গুম হয়ে যাওয়া সেই ছাত্রনেতা, যার তদন্ত করছিল নাহিয়ান। আর এখন, তারই খোঁজে এসেছে মিরা। ‘সে কোথায় গেল, কেউ জানে না!’ চোখে জল নিয়ে বললেন সোহেলের মা। ‘ও শুধু বলেছিল, “আম্মু, এবার সত্য কথা বলব। এখন আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাই না।” তার পর থেকে সে আর কখনো বাড়ি ফেরেনি। শুধু রাতের বেলায় জানালার কাছে একটা গাড়ির আওয়াজ শুনেছিলাম। কালো গাড়ি।’
মিরার মনে পড়ে গেল সেই মাইক্রোবাসের কথা, নাহিয়ানের বাসার সামনেও দাঁড়িয়ে ছিল। সব যেন একই ছায়ায় বাঁধা। পেনড্রাইভে থাকা, অন্ধকার পরিকল্পনা-১৭ ফাইলে উল্লেখ রয়েছে, ‘এটা একটি অঘোষিত অভিযান, যার উদ্দেশ্য, রাষ্ট্রবিরোধী বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় উসকানিমূলক কণ্ঠগুলো চুপ করানো। এই ফাইল শুধু অনুমোদিত ব্যক্তিদের জন্য। ফাইল প্রকাশিত হলে অপারেটরদের দায়িত্ব নিষ্ক্রিয় করা। ফাইলে একটি নাম ঘন ঘন এসেছে, মেজর জেড, কেউ জানে না সে আসলে কে। তার ছবি নেই, রেকর্ড নেই, সবকিছুতে শুধু তার ছায়া।’
মিরা খুঁজে পেল আরেকটি গোপন অডিও ক্লিপ: একজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা গোপনে বলছিলেন, ‘তোমরা জানো না, এই দেশের অন্ধকারে কিছু মানুষ কাজ করে, যাদের নাম নেই, পরিচয় নেই। যখন কেউ সত্য কথা বলে, ওরা এসে সব তছনছ করে দেয়। নাহিয়ান, সোহেল এরা কাপুরুষ নয়, সাহসী। তাদের অপরাধ? তারা নির্ভীক। মেজর জেড? সে একজন নিখোঁজ মানুষের রক্ষাকর্তা নয়, বরং শিকারি।’
সন্ধ্যায় মিরার ইনবক্সে আসে একটি ই-মেইল। তালিকায় কিছু পরিচিত নাম—সোহেল মজুমদার, নাহিয়ান, দীপক করিম (ব্লগার), তাহমিনা হোসেন (অধিকারকর্মী), ও মিরা রহমান। মিরা জানে, এবার সে শুধু অনুসন্ধানকারী নয়, কারও লক্ষ্য। যেকোনো সময় খারাপ ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে।
চার.
২৪ আগস্ট, রাত ৯টা ৩৩ মিনিট, আগারগাঁও, ঢাকা। রাতের শহর যেন এক নিঃশব্দ ফাঁদ। মিরা হুডি পরে, মুখ আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো টেলিকম ভবনের নিচে। ই–মেইল পাঠানো সেই গোপন পরিচয় ‘ছায়া-৭’ বলেছিল, এখানে আছে এমন একজন, যিনি একসময় মেজর জেডের হয়ে কাজ করতেন, কিন্তু এখন নিজেই আতঙ্কে পালিয়ে বেড়ান। মিরা পা রাখে ধুলো-ময়লা মোড়া সিঁড়িতে। পা ফেলার শব্দই যেন বিপদের সংকেত। তিনতলার এক কোণে দেখতে পায় আধো আলোয় বসে আছেন এক ব্যক্তি; চোখ লাল, গালে দাড়ি, হাতে পুরোনো একটি রেকর্ডার।
‘তুমি সাংবাদিক?’
‘হ্যাঁ’ বলে মিরা রহমান।
‘তুমি জানো না তুমি এখন নিশানায়? অন্ধকার পরিকল্পনা-১৭ যাদের টার্গেট করে, তারা আর ফেরেনি। এবার তুমি।’ লোকটি মিরাকে দেন একটি রেকর্ডার।
‘এটা আমি গোপনে রেকর্ড করেছিলাম, ১৭ নম্বর ডিটেনশন সেলে। ওখানে সোহেল ছিল আর নাহিয়ানের কণ্ঠও শুনেছিলাম—চিৎকার, প্রতিরোধ, তারপর নিস্তব্ধতা।’
মিরা কাঁপা হাতে রেকর্ড চালায়, ‘আমি সাংবাদিক, অপরাধী না! আমার মা জানে না আমি কোথায়।’ চাবুকের শব্দ, ‘তোমার সত্য আমাদের অস্থিরতা বাড়ায়। আমরা শান্তি চাই, চুপ করো!’
মিরার চোখ জলে ভরে ওঠে। নাহিয়ান জীবিত ছিল এবং সম্ভবত এখনো কোথাও আছে। রাতেই ফোনে একটা পপ-আপ আসে, সিকিউরিটি আপডেট। আপডেট চাপতেই স্ক্রিন ব্ল্যাক।
ফোন রিস্টার্ট নেয়—সব মেসেজ, ই–মেইল, ড্রাইভ ডিলিট।
পরদিন সকালে মিরা যখন তার সহকর্মী রাফিকে সব জানাতে চায়, সে তাকে থামিয়ে দেয়। ‘তুই এসবে জড়িয়ে পড়ছিস কেন? অফিসে কথা উঠছে। তোর নামে রিপোর্ট গেছে। ওরা তোকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে, মিরা!’
মিরার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সবাই একে একে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। নাহিয়ানের সত্য তার নিজের জীবনকে গিলে খাচ্ছে।
ঠিক রাত ১টা ১৭ মিনিটে আবার একটি নতুন ই–মেইল আসে। ‘যদি খুঁজতে চাও, ৩ সেপ্টেম্বর রাত ২টা, তেজগাঁওয়ে ১৭ নম্বর গুদাম। তুমি একা যাবে। ট্র্যাকার বন্ধ থাকবে। ভুলেও ক্যামেরা সঙ্গে নেবে না।’
মিরা জানে, এই মুহূর্তে তার পিছু নেওয়া হচ্ছে। আর সে জানে, সেখানে যাওয়া মানে হয়তো আর না–ফেরার দেশে গমন করা। কিন্তু থামার সুযোগ নেই।
হঠাৎ একটি অজানা কল। রাত ১১টা ৫৮। মিরার মুঠোফোন, যেটি সে সাবধানতার সঙ্গে শুধুই ডেটা অফ রেখে ব্যবহার করে। নামহীন, কণ্ঠটা কাঁপা ও পরিচিত।
পাঁচ.
ঘড়ির কাঁটা যেন সময় নয়, বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন রাত ১টা ৫২ মিনিট। মিরা এখন দাঁড়িয়ে আছে তেজগাঁও এলাকার বিশাল এক পোড়া গুদামের সামনে। সে একা। মুঠোফোন বন্ধ। চোখে নৈশভ্রমণ চশমা, হাতে ক্ষুদ্র রেকর্ডিং ক্যামেরা। দরজা খুলল, শব্দ করল না। গুদামের ভেতর আধো আলো। প্রথমেই চোখে পড়ে একটা ধাতব সিঁড়ি, নিচে নামার পথ। সিঁড়ির নিচে তিনটি ছোট কক্ষ; ভেতরে শিকল, কাঁটাতার, সাউন্ডপ্রুফ দেয়াল। হঠাৎ একটি কক্ষের দেয়ালে লেখা একটা নাম চোখে পড়ে। মিরা বুঝে ফেলে, এটাই সেই জায়গা, যেখানে নাহিয়ানকে আনা হয়েছিল।
একটা কক্ষের কোনায় ছোট রেকর্ডিং যন্ত্র। মিরা প্লে করে। ‘আপনার শেষ প্রশ্ন কী?’ ‘আমার প্রশ্ন নয়, আমার বার্তা, সত্য কখনো পুরোপুরি হত্যা করা যায় না। আমায় মেরে ফেলো, কিন্তু আমার প্রতিটি সত্য শব্দ, কথা রয়ে যাবে।’ চাবুকের শব্দ, তারপর দীর্ঘ নীরবতা। মিরার হাত কাঁপে। এই কণ্ঠ নাহিয়ানের। সে জীবিত ছিল। হয়তো এখনো আছে। দেয়ালের পেছনে রাখা একটি পুরোনো কম্পিউটার অন করে মিরা। সেখানে একটা এনক্রিপ্টেড ফোল্ডার, ‘অপারেশন ধ্বংসযজ্ঞ’। পাসওয়ার্ড চায়। মিরা নিজের ঝুঁকি নিয়ে হ্যাকিং অ্যাপ ব্যবহার করে ঢুকে পড়ে।
একটাতে দেখা যায়, নাহিয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে মুখোশধারী একজন। তার কণ্ঠে কোনো মানবিকতা নেই। তবে হঠাৎ সে নাম বলে ফেলে, ‘মেজর জেড’! হঠাৎ ভবনের ওপরে কাচ ভাঙার শব্দ। আলো ঝলসে ওঠে। কিছু লোক নিচে নামছে, বুটের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভেতরে কেউ আছে! রেকর্ডার চালু থাকলে ধ্বংস করো! মিরা জানে, তার সময় শেষ হয়ে আসছে। সে দ্রুত রেকর্ডিংগুলো কপি করে ইউএসবিতে আরেকটা ফোল্ডারে জমা রেখে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
সকাল সাতটায় ফার্মগেট মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে একদল শিক্ষার্থী। তাদের হাতে পোস্টার—‘নাহিয়ানকে ফিরিয়ে দাও’, ‘সোহেল কোথায়?’, ‘গুম রাষ্ট্র নয়, গণতন্ত্রের রাষ্ট্র চাই’। এবার মুখোশের নিচ থেকে সত্যের ছবি বের হতে শুরু করেছে। নাহিয়ানের রেকর্ড ভাইরাল হয় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। জনগণ জানে তাকে গুম করা হয়েছে। মিরা জানে, এখন তার পেছনে শুধু গুমকারীরা নয়, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র। তবু সে থামবে না।
ছয়.
চারপাশে নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে ঝিঁঝি পোকার শব্দ। একটা পরিত্যক্ত বাড়ির গ্যারেজ ঘরে লুকিয়ে আছে মিরা। ৭ সেপ্টেম্বর, রাত ৮টা ৪৭ মিনিট। তার চোখ লাল, মাথা প্যাঁচানো পট্টি দিয়ে বাঁধা। তেজগাঁও থেকে পালানোর সময় মাথায় আঘাত লেগেছিল। তার হাতে একটি জিনিস আছে, যা তাকে জাগিয়ে রেখেছে নাহিয়ানের কণ্ঠ, আর রাষ্ট্রের গোপন নথি।
পালিয়ে আসার পর মিরা নথিপত্র ও ভিডিও ফাইলগুলো অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ভয়েস আন্ডারগ্রাউন্ড নামের তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় পাঠিয়েছিল। ভয়েস আন্ডারগ্রাউন্ড সাংবাদিকদের একটি গোপন নেটওয়ার্ক। দুই দিন পর একটি অপরিচিত ই–মেইল আসে—‘আমরা অন্ধকার পরিকল্পনা-১৭ আর্কাইভটি হাতে পেয়েছি। তুমি একা নও, আমরা আছি তোমার সঙ্গে। আমরা সবকিছু প্রকাশ করে দেব। কিন্তু আগে তোমাকে বাঁচতে হবে। ওরা এখনো তোমার পেছনে লেগে আছে।’
হঠাৎ একটি অজানা কল। রাত ১১টা ৫৮। মিরার মুঠোফোন, যেটি সে সাবধানতার সঙ্গে শুধুই ডেটা অফ রেখে ব্যবহার করে। নামহীন, কণ্ঠটা কাঁপা ও পরিচিত। ‘মিরা, আমি নাহিয়ান। আমি পালাতে পেরেছি। বাঁচিনি ঠিক, লুকিয়ে আছি। আমাকে বিশ্বাস করো, অন্ধকার পরিকল্পনা-১৭ এখন আরও ভয়ংকর কিছু করছে। এটা শুধু গুম নয়, এটা জনগণের চেতনা মুছে ফেলার প্রজেক্ট।’ কল কেটে যায়।
মিরা ঘড়ির দিকে তাকায়, মাঝরাত। হৃদয়জুড়ে নতুন আশার স্পন্দন। নাহিয়ান বেঁচে আছে। ভোর চারটায় এক অপরিচিত ই-মেইল থেকে মিরার ল্যাপটপে মেইল আসে। গুম হওয়া ৭৮ জনের তালিকা, যাদের মধ্যে অন্তত ২২ জন সাংবাদিক, বাকিরা ছাত্রনেতা ও অধিকারকর্মী। একটি ভয়ংকর পরিকল্পনা: ২০২৫ সাল নাগাদ সব ডিজিটাল কণ্ঠ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, সন্দেহভাজনদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে, ‘ব্ল্যাকআউট ইউনিট’ সক্রিয় হবে।
আর অপেক্ষা করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় মিরা। এই বার্তাগুলো চুপচাপ ফাঁস না করে, নাগরিকদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সে যোগাযোগ করে ‘চেতনা একাত্তর’ নামের একটি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে। তাদের একজন বলে, ‘আমরা ৭৮ জনের নাম রাজপথে নিয়ে যাব। তুমি শুধু প্রথম আগুনটা ধরাও। বাকি আগুন আমরা ছড়াব।’
পরদিন সকাল ৯টা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাজু ভাস্কর্যের সামনে হঠাৎ বিশাল একটি স্ক্রিন বসানো হয়। সেখানে বাজানো হয় একের পর এক নাহিয়ানের অডিও এবং ভিডিও। স্লোগান ওঠে, ‘অধিকার কেড়ে নিলে, প্রতিবাদ হবেই’, ‘অধিকার নেই যেখানে, প্রতিবাদ হবে সেখানেই’, ‘বঞ্চিতের পাশে দাঁড়াও, ন্যায়ের আলো জ্বালাও’!
সাত.
১০ সেপ্টেম্বর, দুপুর ১২টা ৩০। তীব্র রোদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের বিভিন্ন রাস্তায় মানুষের ঢল। হাতে হাতে পোস্টার—৭৮ জনের নামের তালিকা, নাহিয়ান জীবিত, গুমের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠো। রাজপথে দাঁড়িয়ে আছে মিরা রহমান। তিন সপ্তাহ আগেও সে ছিল একজন সাধারণ অনুসন্ধানী সাংবাদিক। আজ সে প্রতিবাদের প্রতীক। মিরা বলল, ‘আজ আমি আর চুপ থাকব না। এই দেশের মানুষ জানার অধিকার রাখে কারা নিখোঁজ, কেন নিখোঁজ, আর কারা সেই গুমের আড়ালে লুকিয়ে আছে। আমি বলছি, আজ অন্ধকার পরিকল্পনা-১৭ শুধু একটি অপারেশন নয়, এটা একটি রাষ্ট্রীয় মনোভাব, যা প্রশ্নকে ভয় পায়। আমি বলছি, তাদের নাম সোহেল মজুমদার, দীপক করিম, তাহমিনা হোসেন, নাহিয়ান আহমেদ। আজ তাদের মুখ নেই, কিন্তু আমরা সেই মুখ।’
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীতে একযোগে মিছিল। প্রথমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলল, ‘এসব তথ্য বিভ্রান্তিকর, রাষ্ট্রবিরোধী।’ ঠিক এক দিন পর একজন ভুক্তভোগী পরিবার ফেসবুক লাইভে এসে বলল, ‘আমার ভাই গুম হয়েছিল, ভিডিওতে তার কণ্ঠ শুনেছি। এত দিন চুপ ছিলাম। আর নয়।’
এই সাহস ছড়িয়ে পড়ে। নাহিয়ানের চূড়ান্ত বার্তা, ১৩ সেপ্টেম্বর রাত ৩টা ১১ মিনিট। মিরার ফোনে আবার সেই পরিচিত কণ্ঠ, ‘তারা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, কারণ আমি ভাঙব এই বিশ্বাসে। আমি ভাঙিনি, মিরা। তোমার জন্য, জনগণের জন্য, আজ আমি আবার কথা বলছি।’
অন্ধকার পরিকল্পনা-১৭–এর নথি শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে। এক সপ্তাহ পর বিবিসি বাংলার হেডলাইন—‘বাংলাদেশে গুমের বিরুদ্ধে গণ–আন্দোলন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত ঘোষণা। অন্ধকার পরিকল্পনা-১৭ ফাঁস: মানবাধিকারের ইতিহাসে এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করল মিরা রহমান।’
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়