দর্শন ও প্রতিফলনে আবৃত কবি জীবনানন্দ

জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-২২ অক্টোবর ১৯৫৪)প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

বরিশাল শহরের এক ব্রাহ্ম পরিবারে ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয় এক শিশু। যার ডাকনাম ছিল মিলু। সমাজসেবক ও শিক্ষক বাবা সত্যানন্দ দাশের শ্যামল সৌন্দর্যমণ্ডিত ঘর হয়ে ওঠে প্রাণচঞ্চল। মা কবি কুসুমকুমারী দাশের সান্নিধ্যে সাহিত্যচর্চা শুরু হয় অল্প বয়সেই।

বরিশালের বিস্তৃত ধানখেত, নিভৃত ঘর, সন্ধ্যার আলো-আঁধারি রং দাগ কেটে যায় ছোট্ট মিলুর হৃদয়ে। ছোট ছোট অক্ষরে ছন্দ সাজানোর চেষ্টা শুরু তখন থেকেই। হবেই-বা না কেন? বাড়িতে তখন সাহিত্যচর্চা ছিল নিয়মিত।

কখনো শিশিরভেজা ঘাসে বসে, কখনো কাকের ডাকে মুগ্ধ মিলু ছন্দ আর শব্দের খেলায় ডুবতে থাকে। চারপাশের জগৎকে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সে। তাই তার প্রথম লেখায় উঠে আসে—ধানক্ষেতের দোলো হাওয়া, শিউলির গন্ধ, কাশফুলের সুভাস।

রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে যখন কবিতা প্রচলিত ধারা থেকে মুক্তি খুঁজছিল, তখন জীবনানন্দ নিজস্ব ভঙ্গিমায় সেই পথ খুলে দেন।

কবি গ্রামের সাধারণ জীবনকেই ধারণ করেন লেখার প্রধান উপকরণ হিসেবে। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই তিনি প্রতিদিন পিতার কণ্ঠে উপনিষদ আবৃত্তি ও মায়ের কণ্ঠে শুনতেন গান। চারপাশের জগৎ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল মিলুকে।

এই ছোট্ট মিলু একদিন হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশ। বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল তিরিশের দশকে। এই আধুনিকতার সেতু নির্মাণে জীবনানন্দের অবদান অবিস্মরণীয়।

রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে যখন কবিতা প্রচলিত ধারা থেকে মুক্তি খুঁজছিল, তখন জীবনানন্দ নিজস্ব ভঙ্গিমায় সেই পথ খুলে দেন। তাঁর কবিতা শুধু শব্দ নয়; চিন্তার আলো, দর্শনের ছোঁয়া এবং মানুষের অন্তর্দৃষ্টিকে স্পর্শ করে। মানুষের মনে সাড়া জাগায় গভীর থেকে।

জীবনানন্দের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় মায়ের কাছে। ১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে আট বছরের মিলুকে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। ১৯১৫ সালে ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দুই বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় আগের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটান; অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করেন। ১৯১৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। সেই বছরই ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘বর্ষ-আবাহন’ ছাপা হয়। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২২ সালে জীবনানন্দ কলকাতার সিটি কলেজে টিউটর হিসেবে অধ্যাপনা শুরু করেন।

পরে বিভিন্ন কলেজের অধ্যাপনা করেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯২৭-১৯৫৩ সালের সুদীর্ঘ কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। বেকারত্বের কারণে দুবার ইনস্যুরেন্সের চাকরিও করেন। তাঁর চাকরিজীবন মোটেই মসৃণ ছিল না। নির্দিষ্ট চাকরি না থাকায় কবির চাকরিজীবন ছিল ভবঘুরের মতো। কবির দারিদ্র্য জীবনের অন্যতম কারণ ছিল এটি।

আরও পড়ুন

১৯২৭ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হয়। যেখানে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রকট প্রভাব প্রত্যক্ষ হয়। কিন্তু তিনি দ্রুত স্বকীয়তা অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন। পরে দ্বিতীয় কাব্যসংকলন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬)-তে তাঁর স্বকীয় কাব্যকৌশল ফুটে ওঠে। তিনি এক মৌলিক ও ভিন্নধারার জগতে প্রবেশ করান সাহিত্যকে।

১৯৩০ সালের ৯ মে তিনি ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী লাবণ্য গুপ্তের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কবির বেকারত্বের সময় লাবণ্য দাশের শিক্ষকতা পেশাই ছিল জীবন ধারণের উপকরণ।

জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়। ১৯৫৫ সালে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। জীবদ্দশায় কবি তাঁর লেখার খুব বেশি স্বীকৃতি পাননি।

চিরকালীন মমতার সঙ্গে সোঁদা মাটি, ঘাস-ফুল, নদী প্রভৃতির কাছে কবির বারবার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। চিত্ররূপময়ী কবি বারবার ফিরতে চেয়েছেন সেই ‘ধানসিঁড়ি’টির তীরে। নানান বেশে নানান সময়ে কবি ফিরতে চান তাঁর প্রিয় রূপসীর কাছে।

সারা জীবন যেই কবির চিত্ররূপ আমাদের আনন্দিত করে চলেছে; বারবার ফিরে আসার আকুতি যার, তাঁর জীবন মোটেই সুখকর ছিল না। কবির জীবন ছিল দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত। দুঃখকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে করতেই তাঁর লেখায় উঠে এসেছে সেসব অতৃপ্তি। গেয়ে গেছেন ক্লেষ্ট মানুষের জীবনকথা। অনুভব করে ধারণ করেছেন মানবজীবনের ভাবনা। সেসব ভাবনার ব্যাপকতা ছিল গভীর, বহুমাত্রিক। যিনি তাঁর লেখায় কাল ও সময়কে ধরেছেন সচেতনভাবে।

ধূসরতার কবি সারা জীবন কেঁদেই গেলেন। জীবনের শেষ দিনগুলো খুব কঠিন ছিল। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করেছেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে ‘স্বরাজ’ পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক হুমায়ূন কবিরের কাছে জীবনানন্দ দাশের পরপর লেখা তিনটি চিঠিই সেটির প্রমাণ দেয়। চিঠিগুলোয় কবি বারবার একটা চাকরি খুঁজেছেন। বিনীত চিত্তে বারবার নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে একটা কিছু ব্যবস্থা করার অনুরোধ করে গেছেন। দ্বিতীয় চিঠিতে কবি বলেন, ‘ভাগ্য এমনি যে, আজ আমার পেটের ভাত জুটছে না। কিন্তু, আশা করি, একটা দিন আসবে, যখন খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে। আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।’
সত্যিই তা-ই হলো। আমরা পারিনি তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন করতে। বাঙালি খাঁটি হীরা চিনতে বড্ড দেরি করে ফেলল। কবি বলেছিলেন, ‘আমার আর্থিক অবস্থা এখন এতটাই শোচনীয় যে, যেকোনো একজন সকর্মক “অপর” মানুষ যে-কাজ করতে পারে, আমারও তা পারা উচিত!’

আরও পড়ুন

একজন মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা কেমন ছিল, তা উপলব্ধি করতে এই কথাগুলোই যথেষ্ট। কবির জীবন ছিল সত্যিই ক্লান্ত।

১৪ অক্টোবর, ১৯৫৪ সালে কলকাতার ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন জীবনানন্দ দাশ। সাহিত্যিক সজনী কান্ত দাশের অনুরোধে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন এবং আহত কবির সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যদিও এতে তাঁর তেমন উন্নতি হয়নি। জীবনানন্দ দাশের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। আক্রান্ত হন নিউমোনিয়ায়। ২২ অক্টোবর, রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে বাংলার বুক থেকে ঝরে পড়ে এক শুদ্ধতার কবি। তিমির হননের কবি অন্ধকারে পাড়ি জমালেন চিরতরে।

মৃত্যুর আগে জীবনানন্দ দাশ নিভৃতে ২১টি উপন্যাস ও ১০৮টি ছোটগল্প রচনা করেছেন। জীবিকার কোনো সুস্থির পথ না থাকায় কবি আমৃত্যু সংগ্রাম করেই বেঁচেছেন।

জীবনানন্দ গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দসহ কেউ কেউ ধারণা করেছেন, আত্মহত্যার স্পৃহা ছিল জীবনানন্দের ট্রাম দুর্ঘটনার মূল কারণ। জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন, জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে কাবু করেছিল এবং তাঁর জীবনস্পৃহা শূন্য করে দিয়েছিল। মৃত্যুচিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি নাকি প্রায়ই ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন।

জীবনানন্দ দাশ আধুনিক কবি হলেও গ্রামবাংলার উপাদান-উপকরণ তাঁর কাব্যে পেয়েছে স্বচ্ছন্দ প্রবেশ অধিকার। নিসর্গ চেতনায় ইতিহাসবোধের অনুপ্রবেশ ও সঞ্চার ঘটেছে সমানতালে।

জীবনানন্দের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য প্রকৃতি ও মানবচেতনার মিলন। যা পাঠককে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে। তাঁর কবিতায় দর্শন ও প্রতিফলন মিলিত হয়েছে নিপুণভাবে। অন্যতম উদাহরণ ‘বনলতা সেন’ কবিতা। নীরব গ্রামীণ পরিবেশ, শিউলি ফুলের ঘ্রাণ, কাশফুলের সোনালি আলো—এসব লেখা যেন একেকটা গবেষণার প্রতিফলন। কবিতায় সময়, মৃত্যু এবং একাকিত্বের অনুভূতিও স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি; যা পাঠককে শুধু আবেগঘন নয়, বৌদ্ধিকভাবে ভাবতে প্রলুব্ধ করে। জীবনানন্দের জীবনও ছিল তাঁর কবিতার মতোই গভীর ও রহস্যময়। তাঁর শব্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বোধ, দর্শন ও চিন্তার গভীরতা বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের চিরকাল আকর্ষণ করে গেছে।

কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় যে সময়টা ধারণ করতে চেয়েছেন, তা একাধারে বর্তমান ও ভবিষ্যতের। এ কারণে তাঁর লেখার সব উপজীব্য দূর ভবিষ্যতেও থাকবে প্রাসঙ্গিক। প্রতিটি লেখা যেন বর্তমান। প্রতিটি মানবমনের দর্শন, অনুভূতি যেন আজও আটকে আছে সেই সময়ে; জীবনানন্দের পঙ্‌ক্তিতেই আটকে আছি আমরা। থাকবে হয়তো বহু প্রজন্ম।

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ