‘বিদ্রোহী’ স্থান পেলেও ‘প্রলয়োল্লাস’ কেন সঞ্চিতায় স্থান পেল না
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী ছিল ১১ জৈ৵ষ্ঠ। ১২৬তম জন্মবার্ষিকীতে কবির প্রতি ভালোবাসা।
সূর্য যেমন সব অন্ধকারের বুকে আলো ফেলে আকাশকে মহিমান্বিত করে, গর্বিত করে। কাজী নজরুল ইসলামও তেমনি বাংলা সাহিত্যকে আলোকিত করেছেন। হৃদয়ের প্রাচীনতম ব্যথা-বেদনা, যন্ত্রণা, আনন্দ, অবহেলা, শোষণ, অবিচার, অন্ধকার, পরাধীনতা, সাম্যবাদিতা—কোথায় পৌঁছাননি তিনি। তাঁর কণ্ঠে একই সঙ্গে রচিত হয়েছে বিদ্রোহ ও সৃষ্টির বাণী। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার গান গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শান্তির শৃঙ্খল রচনার মর্মবাণীকেও মূর্ত করে তুলেছেন। দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছেন, ‘মম এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য’।
অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতা ‘বিদ্রোহী’। প্রথম কবিতা ‘প্রলয়োল্লাস’। অগ্নি-বীণা, ঝিঙে ফুল, সর্বহারা, ফণি-মনসা, ছায়ানট, দোলন-চাঁপা, সিন্ধু-হিন্দোল, চিত্তনামা, বুলবুল, জিঞ্জীর ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে নিজেই সঞ্চিতার জন্য কবিতা ও গান নির্বাচন করেন নজরুল। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’কে সঞ্চিতায় স্থান দিলেও ‘প্রলয়োল্লাস’কে কেন রাখলেন না?
‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে–/ মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে/ আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।’ সঞ্চিতার দ্বিতীয় কবিতার পঙ্ক্তি। কবিতার শিরোনাম ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, কাব্যগ্রন্থ দোলন-চাঁপা। কবিতাটিতে নজরুল নিজের সৃষ্টির সাধনারই উদ্যাপন করেছেন। কবি হৃদয়ের আবেগ, দহন, যন্ত্রণা, অভিমান, প্রতিবাদ কাব্যশক্তিতে প্রস্ফুটিত হয়। নজরুলের বেশির ভাগ কবিতার ক্ষেত্রে বোধ করি এটা ঘটেছে। কবির বিদ্রোহী মননের রেশও কবিতাটিতে প্রবাহিত হয়েছে। বিদ্রোহের সুরেই কাব্য প্রতিভার স্বাক্ষর পৃথিবীর আকাশে বাতাসে ধ্বনিত করতে চেয়েছেন। বলেছেন, ‘আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে/ আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!’
নজরুল প্রতিবাদে-সংগ্রামে এতই বিশাল যে তাঁর প্রতিবাদী হৃদয়ের অন্তরালের কোমল হৃদয় আর সেই কোমল পদ্মপুষ্পের প্রকাশ অনেক ক্ষেত্রে অনুচ্চারিত থেকে যায়। ছায়ানট কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘ব্যথা-নিশীথ’। কবিতাটিকে সঞ্চিতায় স্থান দিয়েছেন কবি। মানবহৃদয়ের অত্যন্ত কাছের দুই উপঢৌকন আনন্দ আর বেদনা; এই দ্বৈরথের যুথ বেগ ও আবেগের পসরা ‘ব্যথা-নিশীথে’ মূর্ত হয়েছে। গানের পাখি নজরুল, ঠিক গানের ভঙ্গিতেই যেন উচ্চারণ করেছেন, ‘মম ব্যর্থ জীবন-বেদনা/ এই নিশীথে লুকাতে নারি। / তাই গোপনে একাকী শয়নে/ শুধু নয়নে উথলে বারি।’
নজরুল প্রতিবাদে-সংগ্রামে এতই বিশাল যে তাঁর প্রতিবাদী হৃদয়ের অন্তরালের কোমল হৃদয় আর সেই কোমল পদ্মপুষ্পের প্রকাশ অনেক ক্ষেত্রে অনুচ্চারিত থেকে যায়।
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ যেকোনো লড়াইয়ে-সংগ্রামে, স্বপ্নে নজরুলের এ বাণী নিকেল ঝরা রোদের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। প্রতিটি পদক্ষেপে চিরস্মরণীর সত্যের মতো এই উচ্চারণও অনির্বচনীয়। ‘নারী’ কবিতায় নজরুল যেমন অধিকার, অগ্রসরতা ও জাগরণের গান গেয়েছেন, তেমনি বিপুলা পৃথিবীর মতো ‘নারী’কে ঐশ্বর্যময়তার প্রতীক করে তুলেছেন। বলেছেন, ‘পুরুষ হৃদয়হীন,/ মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।’
‘দেখিনু সেদিন রেলে,/ কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে ফেলে দিলে নিচে ফেলে!/ চোখ ফেটে এল জল,/ এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’ দুর্বলের প্রতি সবলের আঘাত। শ্রেণিবৈষম্য, শোষণ, অবহেলা, বঞ্চনা ‘কুলি মজুর’ কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে ধ্বনিত হয়েছে। কবিহৃদয় মানুষের জন্য, জীবনের জন্য, অন্যায়ে-শোষণে গোলাপের কাঁটার মতো কাঁটায় বিঁধতে থাকে, রক্তাক্ত হয়। সেই যন্ত্রণার বায়ুপুষ্পই বোধ করি কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে। পাঠকহৃদয়কে নানাভাবে তা ভাবায়, ভাবতে বাধ্য করে। তাই তো নজরুল প্রতিবাদের স্বর তুলেছেন কণ্ঠে। পাশাপাশি ‘শুভদিন’ এসে একদিন সব ধুয়েমুছে দেবে সেই প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছেন।
সঞ্চিতার জন্য সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের ‘নারী’, ‘কুলি মজুর’ কবিতাকে কবি যেমন নির্বাচন করেছেন তেমনি ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থ থেকে বেছে নিয়েছেন ‘ঝিঙে ফুল’, চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘রাজ-ভিখারী’ ইত্যাদি কবিতা। বুদ্ধদেব বসু ‘নজরুল ইসলাম’ শিরোনামের প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘কথার চেয়ে বেশি তাঁর হাসি, হাসির চেয়ে বেশি তাঁর গান।’ নজরুল নিজেও বলেছেন, ‘সাহিত্যে দান আমার কতটুকু, জানা নেই। তবে এইটুকু মনে আছে, সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি।’ তাই তো সঞ্চিতায় নিজের প্রিয় গানকেও স্থান দিতে কার্পণ্য করেননি। ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল্’, ‘বসিয়া বিজনে কেন একা মনে’, ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’ ইত্যাদি গান স্থান পেয়েছে সঞ্চিতায়।
সঞ্চিতা গান-কবিতার অকৃত্রিম মেলবন্ধনে সৃষ্ট এক মনোহর পুষ্পবৃক্ষ। যেখানে প্রতিটি কবিতা ও গানে মানবজীবনের নানা অনুভূতির ব্যঞ্জনা প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি ঝরনার মিলিত ধারার মতো বিদ্রোহের সঙ্গে মিলে গেছে নজরুলের সুগভীর জীবনবোধ।
সঞ্চিতাকে নজরুল আখ্যায়িত করেছেন, ‘আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া রচিত পুষ্পাঞ্জলি’ বলে। সঞ্চিতা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে। প্রকাশের সময়ই বইটি পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। নজরুল সঞ্চিতা উৎসর্গ করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
একটি প্রশ্ন রেখেছিলাম শুরুতে, ‘বিদ্রোহী’ স্থান পেলেও ‘প্রলয়োল্লাস’ কেন সঞ্চিতায় স্থান পেল না? নজরুল পাঠের উপলব্ধি থেকে প্রশ্নটির উত্তর দিয়ে শেষ করছি। সঞ্চিতায় নজরুল নিজের বৈচিত্রময়তার সন্ধান করার চেষ্টা করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘প্রলয়োল্লাস’ ও ‘বিদ্রোহী’ একই সারির এবং দুটিতেই একই বেগ ও দোদুল্যমানতা প্রবহমান থাকায় কবি ‘বিদ্রোহী’কে রাখাই যুক্তিযুক্ত মনে করে থাকতে পারেন।
কার্যনির্বাহী সদস্য, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ