কাশফুলের দিন (তৃতীয় পর্ব)

পদ্মা নদীর চরে শুভ্র কাশফুলছবি: হাসান মাহমুদ
প্রশ্নটি রহিমার চিত্তে বাজল কি না, ঠিক বোঝা গেল না। তবে খানিকটা যন্ত্রচালিতের মতো ও বলল, সুরমার বাবা মজিদ মিয়া তাকে ডেকেছেন একবার।

বন্যার পানি নেমেছে কয়েক দিন হলো। মেঠো পথের দুই ধারে ধু ধু করা ফাঁকা ফসলি জমির মাথার ওপর ভরা যৌবনের সোনালি সূর্য। রাস্তার দুই পাশের সবুজ ঘাসগুলো তামাটে রঙের হয়ে আছে। এত দিনের ক্লেশ আর খেটে খাওয়া মানুষগুলোর সব পরিশ্রম বয়ে এ পথের বয়স বেড়েছে অনেক। পরিশ্রমী পাকা শরীরের মতো টিকে আছে সব দুঃখ–দুর্দশা বুকে চেপে।

এ পথ ধরে গঞ্জের দিকে হেঁটে রওনা দিয়েছে সুরমার বাবা মজিদ মিয়া। সাদা ধবধবে লুঙ্গির খুঁট ধরে দ্রুতপায়ে হাঁটছে। একই পথ ধরে এগোচ্ছিল রহিমা। দূর থেকেই মজিদ মিয়াকে দেখে সতর্ক হয়ে গেল। গত রাতের বৃষ্টিতে এ রাস্তার মোড়ের কাছটিতে বেশ কাদা জমে আছে। সেখানে এসে রহিমার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা মজিদ মিয়ার। ওড়না টেনে মাথা ঢেকে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল রহিমা।
‘কোথায় যাচ্ছ, মা?’ গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল মজিদ মিয়া।
‘একটু সামনেই যাব, চাচা।’
মুখে খানিক হাসি টেনে মজিদ মিয়া বলল, ‘আচ্ছা, তা যাও। তোমার বাবাকে একবার বলবে চাচা স্মরণ করেছেন।’
‘জি, বলব’, মাটির দিকে তাকিয়ে খানিকটা ঘাড় নেড়ে উত্তর দিল সে।

শরতের নরম বিকেল তখন শেষ হয়ে আসছিল। অন্ধকার নামা শুরু করেছে। আশপাশের ঘরগুলোয় এখনো ঠিকঠাক সন্ধ্যাবাতি জ্বালানো হয়নি। ব্যস্ত বিকেল পার করে খেলার মাঠ থেকে বাচ্চারা ফিরছে হাঁটু পর্যন্ত মাটি আর কাদা মাখিয়ে। তাদের সারা বিকেলের উল্লাস আর প্রত্যেকের নানা অভিযোগ আর তর্কবিতর্ক শুনতে শুনতে বাড়ি ফিরে এল রহিমা। তার দেহমনে শাহাদাতকে নিয়ে হাজার রকমের কল্পনা খেলা করছে। বৃদ্ধের উৎকট ভর্ৎসনা কানে পৌঁছাতেই ভয়ে আঁতকে উঠল রহিমা। ‘এত বড় মেয়ের সারা গ্রাম ঢ্যাং ঢ্যাং করে বেড়ানো কেন?’

প্রশ্নটি রহিমার চিত্তে বাজল কি না, ঠিক বোঝা গেল না। তবে খানিকটা যন্ত্রচালিতের মতো ও বলল, সুরমার বাবা মজিদ মিয়া তাকে ডেকেছেন একবার। ধনাঢ্য প্রতাপশালী মজিদ মিয়ার নিকট ডাক পড়েছে শুনেই বৃদ্ধের রুক্ষ মুখখানি আষাঢ়ে মেঘের মতো কালো হয়ে উঠল। সে দুশ্চিন্তার ছাপ এ সন্ধ্যার আঁধারিতে রহিমার চোখে পড়ল না। তবে দেখতে পেল, বাবা হঠাৎ শান্ত হয়ে গেছে।

রহিমাদের বাড়ির পাশে কয়েকটা বাড়ি। একটু দূরেই চৌধুরীদের বড় আমবাগান। বাকি সবটা ফসলি জমি। বছরের অধিকাংশ সময়ই বিভিন্ন রকমের ফসল চাষ হয়। ফসলি মাঠ পার হয়েই বনের চর। বর্ষা শেষ হতেই কাশফুলে ভরে ওঠে জায়গাটা। এই বিস্তৃত কাশফুলের সাদা রাজ্য পেরিয়েই খরস্রোতা পদ্মা।

আরও পড়ুন

পদ্মার পাড়ে রহিমাকে নিয়ে এসেছে শাহাদাত। ঘন কাশফুল ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। তখন পশ্চিমের সূর্য ঢলে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ক্রমেই চারপাশটা অস্তমিত সূর্যের লালটে আভায় রং বদলাচ্ছে। কাশফুলের এই বিস্তৃত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে কিশোরীর ক্ষুদ্র কোমল হাতখানি ধরে দ্রুতপায়ে নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শাহাদাত। রহিমার মধ্যে অচেনা ভয় ভিড় করতে লাগল। ভয়ার্ত কণ্ঠে সে মিনতির সুরে শাহাদাতকে বলল, ‘চলো বাড়ির দিকে যাই, সন্ধ্যা হয়ে আসছে।’ শাহাদাত সে কথায় কান না দিয়ে এগিয়ে চলছে। কাশফুলের মাঠ পার হয়ে এসে থামল ওরা। এখান থেকে নদী দেখা যায়, আর পেছনেই কাশফুলের ঘন অঞ্চল। তারা বসল। সূর্য অনেকটাই পশ্চিম কোণে হেলে পড়েছে। রহিমার কাঁধের ওপর বাঁ হাত রেখে ওর পাশে ঘাসের ওপর বসল শাহাদাত, আরেকটি হাত ব্যস্ত হলো রহিমার অন্য হাতের স্পর্শ নিতে। তরুণীর কোমল বাহু জোড়া গৃহস্থালির নানা রকমের শক্ত কর্মে অভ্যস্ত ছিল; তবে এ সায়াহ্নকালে প্রণয়ীর হাতের স্পর্শে রোমাঞ্চিত হওয়ার মতো পরিণত বোধ হয় তখনো হয়ে ওঠেনি। লজ্জায় অথবা শাহাদাতের প্রতি তীব্র রাগমিশ্রিত ঘৃণায় দাঁতে দাঁত রেখে মনের সঙ্গে নানা বাগ্‌বিতণ্ডায় ব্যস্ত হয়ে গেল। দুজনই চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে শাহাদাত বলল, ‘চুপ করে আছ কেন? মন খারাপ তোমার?’

অপর পক্ষ থেকে উত্তর না পেয়ে রহিমাকে আরেকটু কাছে টেনে নিতে চাইল শাহাদাত। এবার ফুঁসে উঠল রহিমা। নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ওর থেকে। শাহাদাতের মুখের দিকে একমুহূর্তের জন্য তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। ঘন কাশফুলের মধ্য দিয়ে দ্রুত চলে গেল সে। যাওয়ার সময় রহিমার দুচোখ ভরা টলমল অশ্রুধারা দেখতে পেল শাহাদাত। পশ্চিমের সূর্য অস্তমিত, আঁধার নামতে শুরু করেছে। এ অন্ধকারের মধ্যেও শাহাদাতের চোখে প্রেয়সীর ভেজা প্রিয় চোখ জোড়া!

আরও পড়ুন

কিছুদিন পর সুরমাদের বাড়ির বড় গেট পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করল বৃদ্ধ কাদের মিয়া। মাথার ওপর সূর্য, মধ্যদুপুরের তির্যক রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছে সুরমাদের বড় উঠানজুড়ে। ঘরে এত দিনের ওঠানো ধানগুলো তাতে রোদে দেওয়া হয়েছে। এক কোণে দাঁড়িয়ে নিরস শুকনা মুখে খানিকটা হাসি টেনে উঁচু গলায় ডাকল ‘মিয়া ভাই’ বলে। ভেতর থেকে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে আওয়াজ এল, ‘কে ডাকে এ অসময়ে? ভেতরে আসা হোক।’

মধ্যাহ্নভোজ শেষ করে ভাতঘুম দিতে বিছানায় গিয়েছিল মজিদ মিয়া। আর এই অসময়ে কাদের মিয়ার ডাক। খানিক বিরক্তি বোধ করলেও তিনি ঘুমের ভাবটা পাছে কেটে যায়, এ ভয়ে দ্রুত কথা শেষ করে বিদায় করে দিতে চাইছিলেন কাদের মিয়াকে। কাদের মিয়ার অনুরোধ বা দুঃখের গল্প—কোনোটাই শুনতে আগ্রহ দেখালেন না। বৃদ্ধ যদিও যেচে বলতে চাইছিল। তাতে বাধা দিয়ে মজিদ মিয়া সাফ জানিয়ে দিল, টাকাটা আর ফেলে রাখা চলবে না। সে খবর পেয়েছে, বন্যার পানি নেমে পদ্মার চরে তাদের জমি বেরিয়েছে। সেখানে তাদের সব ভাইয়ের ভাগ–বাঁটোয়ারা করে কাদের মিয়ার ভাগে যতখানি সম্পত্তি পড়বে, তা বিক্রি করে নিজের প্রাপ্য টাকাটা সুদসহ বুঝে নেবে সে।
মুখখানা শুকিয়ে গেল। চোখ জোড়া নিমেষেই ভিজে উঠল। প্রাণপণে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বাড়ির দিকে ফিরল কাদের মিয়া।

আসার সময় মনে মনে ভাবল, জমিটা বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিল। না হয় ভালো পাত্র হাতছাড়া হয়ে যাবে। ওই চৌধুরী যা ধূর্ত, তাতে সবটা জমিই নিজের করে নেবে, চড়া সুদে একদমই সর্বস্ব কেড়ে নেবে ওর কাছ থেকে। ভাবতে ভাবতে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল রুক্ষ গাল বেয়ে। দ্রুতই তা মুছে নিল।

চলবে...

শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়