কাশফুলের দিন (প্রথম পর্ব)

আকাশের সাদা মেঘের সঙ্গে সাদা কাশফুলের সখ্যতাছ‌বি: এ বি আরিফ

রহিমাদের স্কুলের হেডমাস্টার বলেছেন, স্কুল বেশি দিন চলবে না, কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে। সারা দেশেই পানি বাড়ছে। তাদের স্কুল ঘরের সিঁড়ি পর্যন্ত পানি। স্কুল মাঠের ঘোলা পানির দিকে ভালোভাবে নজর দিলে দেখা যায়, সবুজ ঘাসগুলো হলুদ হয়ে উঠেছে।
এখনো ভেলা ভাসিয়ে স্কুলে আসার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তার আগেই হয়তো স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষকেরা বলাবলি করছেন, এবার বন্যার পানি সহজে নামবে না।
দুয়ারে পানি চলে আসছে, দুই-এক বেলার মধ্যে ঘরে উঠবে। সে চিন্তা বৃদ্ধ কাদের মিয়ার রুক্ষ এলোমেলো চুল আর কুঁচকানো মুখের প্রতিটা ভাঁজে স্পষ্ট।

বারান্দায় খুঁটির সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বাঁশঝাড়ের দিকে তাকিয়ে বিকেল গড়াল তাঁর। বাঁশঝাড়ের ময়লা পানির মধ্য দিয়ে কেউ একজন আসছিল মনে হয়; কাদের মিয়ার গলা খাঁকড়ানিতে সে পথ চলা যেন থেমে গেল। সেদিকে তাকিয়ে কিছু দেখতে পেলেন না। কেবল দেখতে পেলেন, ঘোলা পানি আর পশ্চিম আকাশের কোণে মেঘ জমেছে। রাতে বৃষ্টি নামবে হয়তো। ঘন অন্ধকারে মেঘের দিকে তাকিয়ে কাদের মিয়া বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়াচ্ছিলেন, বুকে জমা দীর্ঘশ্বাস অভিমানের স্বরে মৃদু মৃদু বলছিলেন, বেলা বাড়ছে, আঁধার নামছে। এ আঁধারে যদি তাঁর জীবন ঘনিয়ে আসে, আজ রাতেই সেসব চিন্তার ইতি টেনে বিশ্বধরার ব্যস্ততায় হারিয়ে যেতে পারতেন! তাহলে হয়তো রহিমার বিয়ের ভাবনা, এ সংসারের বোঝা টানার অসহায়ত্ব আর দারিদ্র্যের করুণ সুর তাঁকে শুনতে হতো না।

বিছানার ওপর কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে রহিমা। পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে আধশোয়া অবস্থায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। অন্ধকার নামছে। অর্ধনিমীলিত চোখ জোড়ায় ভেসে উঠছে শাহাদাতের আবছা চেহারা। স্বাস্থ্যবান জোয়ান ছেলে, মুখে বসন্তের দাগ, গায়ের রং কালো হওয়ায় দাগটা অস্পষ্ট। চোখের মাপে রহিমার চেয়ে বছর কয়েকের বড় হবে। তবে তারা একই ক্লাসে পড়ে।

শাহাদাত কিছুদিন হলো স্কুলে আসছে না। স্কুলে এলেই সে জ্বালাতন করে। সারাক্ষণ পিছু পিছু বকবক অথবা রহিমাকে দেখলেই পাশের কারও ওপর জোর খাটানো। শক্তির জাহির করা। রহিমার বিরক্ত লাগত। ওর মেয়ে বন্ধুগুলো তাকে নিয়ে নানা ধরনের কথা বলত। তবু আজ শাহাদাতের কথা মনে পড়তেই রহিমার চেহারায় হাসি ফুটল। বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে শক্ত হয়ে বসে বাইরের পানির দিকে তাকাল। পানি বাড়ছে। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে শাহাদাত কি একদিনও আসবে না? আর একবারও দেখা হবে না? এসব ভাবতেই রহিমার মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। ঈষৎ হাসি মুখে টেনে বিছানা থেকে নামতেই মায়ের কাঁপা কণ্ঠ কানে বাড়ি খেল।

অপবাদের প্রতিধ্বনি কান থেকে সরতেই রহিমা আবার বসে পড়ল। ঘাড় বাঁকা করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। চোখে ভাসছে বন্যার পানি, আর অনিচ্ছায় শুনতে হচ্ছে বাবা-মায়ের অশ্রাব্য ভাষা। মনে অভিমান দানা বেঁধেছে

পঁয়ত্রিশের যুবতী মহিলা বৃদ্ধ কাদের মিয়াকে ভর্ৎসনার স্বরে বলছিলেন, ‘আঁটকুড়া গোলাম! ঘরের বাইরে পা দেওয়ার জো নেই। পুরুষ মানুষ বাজারঘাটে যাবে না একটু। তা উনি বারান্দায় দাঁড়ায়ে থাকলেন বিকেলভর।’ এ পর্যন্ত এসে মুখ খুললেন কাদের মিয়া। তীব্র উত্তেজনায় কান্নাসিক্ত গলায় বললেন, ‘আমি বাইরে যাই আর তোর সুবিধা হোক, শুতে পারিস রাত না হতেই, তা-ই না। তোর এত গলার তেজ আর টাকাগুলো কোথা থেকে আসে, কোনো খবর রাখি না, তাই মনে করিস!’

রহিমা সব শুনছে। বাবা-মায়ের কথা-কাটাকাটি বা ঝগড়া নিয়মিতই হয়। কিন্তু বাবা এমনভাবে মায়ের চরিত্র নিয়ে অপবাদ আজই প্রথম দিল। দুই হাতের মুঠি আপনা হতেই শক্ত হয়ে এল রহিমার। বিছানায় বসে পড়ল, গাল বেয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। যে কলঙ্কের শব্দ আজ সে শুনল, তা কত দিনে ভুলতে পারবে জানে না। তবে এ যেন সত্যি না হয়, সে প্রার্থনা বিধাতাপুরুষের কাছে বারবার তুলছে।

অপবাদের প্রতিধ্বনি কান থেকে সরতেই রহিমা আবার বসে পড়ল। ঘাড় বাঁকা করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। চোখে ভাসছে বন্যার পানি, আর অনিচ্ছায় শুনতে হচ্ছে বাবা-মায়ের অশ্রাব্য ভাষা। মনে অভিমান দানা বেঁধেছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছে। চোখ বুজে টিনের বেড়ায় মাথা ঠেকিয়ে বসে রইল সে। হয়তো সেদিন অভিমানেই প্রতিজ্ঞা করেছিল, শাহাদাতকে আর বাধা দেবে না। অভিমানের বশে করা এ প্রতিজ্ঞার রেশ কত দূর গিয়ে ঠেকবে, জানা ছিল না। শুধু ছিল চোখের শুকনা পানি, সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার আর স্তব্ধ অভিমান।

পরদিন রহিমা স্কুলে গিয়ে দেখল, বারান্দা পর্যন্ত পানি। স্যাঁতসেঁতে ভেজা বারান্দায় হেডমাস্টার দাঁড়িয়ে, আর চারপাশে গোল করে দাঁড়িয়ে আছে শিক্ষার্থীরা। হেডমাস্টার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, ‘কাল থেকে তোমাদের ছুটি। কাউকে আসতে হবে না। আবার পানি নামলে স্কুল খুলবে। তোমাদের বাড়ির কেউ অসুস্থ হলে আমাদের খবর দেবে। আমাকে বাড়িতেই পাবে।’

পেছন থেকে রহিমার চুল ধরে কেউ একজন টেনে ধরল। পেছনে তাকিয়ে দেখল শাহাদাত। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। মুখ ফেরাতেই বলল, ‘ওই কেমন আছ।’
কোনো জবাব না দিয়ে মুখ ঘুড়িয়ে নিল রহিমা। আরও একটু এগিয়ে এল শাহাদাত। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘ওই রহিমা, ওই ওই, রহিমা ওই’। রহিমা ভয় পাচ্ছিল, যদি হেডমাস্টার দেখে ফেলেন! যদি সবার সামনে অপমান করেন!

একটু সরে গিয়ে হেডমাস্টারের কাছে দাঁড়াল রহিমা। তাকিয়ে দেখল, শাহাদাতের মুখে অন্ধকার। যেন মাত্রই বড় কোনো বিপর্যয় হলো।

চলবে….

শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়