কাশফুলের দিন (দ্বিতীয় পর্ব)

দীর্ঘ সাদা কাশবনে বিকেলের আলোতে বিহ্বল করা রূপ খুলেছিল কাশফুল। প্রতীকীছবি: প্রথম আলো
মাঝেমধ্যে মেঘ কেটে নীল আকাশে সূর্যের দীপ্তি প্রকাশ পেলে বৃদ্ধ কাদের মিয়ার মুখের চিন্তার ভাঁজগুলো কম্পিত প্রদীপের শিখার ন্যায় আশার আলো দেখতে পেত। তবে নীলাকাশ কোনো এক অদ্ভুত কারণে রহিমার অপছন্দের বস্তুতে পরিণত হয়ে যায়।

রহিমাদের বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকেছে পানি। প্রতিদিনকার মতো সে আজও বিছানায় বসে আছে। জানালা দিয়ে অদূরে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। ধীরে ধীরে দিনের আলো ক্ষীণ হয়ে আসছে, একটু বাদেই সন্ধ্যা নামবে। হাঁটু অবধি পানি ডিঙিয়ে কেউ একজন আসছে মনে হলো। ওর বোন রত্না ছোট ছোট পায়ে হেঁটে আসছে সুরমা আপার হাত ধরে।

সুরমা গ্রামের ধনী ঘরের মেয়ে। গ্রামের অধিকাংশই অশিক্ষিত। এ কারণে শ্রেণিবৈষম্যের আকার এখানে প্রকট। তাই স্বভাবতই রহিমা ও সুরমার সখ্য এই প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের লোকেদের চোখব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুরমার উৎসাহ ছিল বেশি। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ভাব জমাতে চাইত তার সঙ্গে। অবশ্য তার থেকে যে পাওয়ার কিছু নেই সুরমার, সেটা রহিমা নিজেও জানে।

রত্নাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল সে। রহিমা বিছানা থেকে নামল না। শুয়ে শুয়েই পার হয়ে গেল বিকেল থেকে সন্ধ্যা। সেদিন ভরা জ্যোৎস্না ছিল। টানা বৃষ্টির পর রাতের আকাশ স্বচ্ছ। বাইরের চারপাশে শুধু পানি। চাঁদের কিরণ সরাসরি এসে পড়ছে পদ্মার বুকে।

আমরা প্রচণ্ড কৌতূহলী। না জানাকে জানার আগ্রহ বরাবরই আমাদের মধ্যে প্রবল। প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের মানুষ ভিন্ন বাকি যে কেউ আজকের এই জ্যোৎস্নাশোভিত রাত উপভোগ করবে। চাঁদের আলোয় নৌকা ভাসিয়ে রহিমাদের জানালার পাশ দিয়ে চলতে থাকবে, আর হয়তো প্রকৃতির মাধুর্যতার প্রশংসায় মুখ ফেরাবে না। এমন রাতেও রহিমাদের চোখেমুখে শুধু ভয়। তাদের ঘুমাতে হয় মৃত্যুভয় নিয়ে! গভীর ঘুমের মধ্যেও অকস্মাৎ কোনো মৃদু শব্দ কানে আসামাত্রই ধড়ফড় করে জেগে উঠবে সাপের শব্দ ভেবে। আর পেটের ক্ষুধার জন্য চেয়ে থাকতে হবে অন্যের মুখপানে।

পরদিন ভোর হলো, সময়মতো আবার সন্ধ্যাও নামল। এভাবে দিন যাচ্ছিল অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে।

বাড়ি থেকে পানি নামল সপ্তাহখানেক বাদে। এর মধ্যে রহিমা ভাবলেশহীন স্বভাবে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল। জানালা দিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকায় ও সুখ খুঁজে পাচ্ছিল। মেঘ যখন বৃষ্টি হয়ে নামত, তখন ওর এক রত্তি ঈষৎ কৃষ্ণবর্ণের মুখে আলোর ঝিলিক চোখে পড়ত। মাঝেমধ্যে মেঘ কেটে নীল আকাশে সূর্যের দীপ্তি প্রকাশ পেলে বৃদ্ধ কাদের মিয়ার মুখের চিন্তার ভাঁজগুলো কম্পিত প্রদীপের শিখার ন্যায় আশার আলো দেখতে পেত। তবে নীলাকাশ কোনো এক অদ্ভুত কারণে রহিমার অপছন্দের বস্তুতে পরিণত হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

এই যে আমাদের এত ব্যস্ততা, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুটে চলা, তার সবটাই এক ফোঁটা সুখের প্রত্যাশায়। অথচ বেলা ফুরানোর পর আমরা আক্ষেপ করি ওপরের দিকে চেয়ে। অথবা পেছন ফিরে বলি, চলে যাওয়া দিনটাই সুন্দর ছিল। আজকের এই বর্তমানে আমরা তুষ্ট নই। এই বর্তমান যেদিন কালের অতীতে নাম পাল্টাবে, তখন আমরা অদ্ভুতভাবে এতে সুখ আবিষ্কার করে নেব। সেটাও হবে সুখের দিকে চেয়ে অসুখে দিনপাত করা।

রহিমারও ঠিক তেমন মনে হচ্ছিল। এই বন্যায় সারাক্ষণ ভয়ে পার করা সময়ের মধ্যে সুখের রেখা আঁকছিল মেঘেদের দিকে চেয়ে। রহিমার ঝাপসা দৃষ্টিতে শুধু ভাসছে শাহাদাতের সঙ্গে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পার করানোর কথা।

সেদিন বিকেলে ওর চোখের কোণে জমা হওয়া একরাশ শূন্যতায় রহিমা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তারপর বৃদ্ধ কাদের মিয়ার পুরোনো বাড়ির ডুবন্ত উঠানের ওপর দিয়ে ভেলা ভাসিয়ে দেখা করতে যেত রোজ বিকেলে। গ্রামের যেদিকটায় পানিতে ডোবা ফাঁকা মাঠ, আর শেখদের ঘন জঙ্গলে সারাক্ষণ সন্ধ্যার আলো-আঁধারি থাকে, সেখানটায় তারা দেখা করত। শাহাদাত ওর ঈষৎ কালো রঙের মুখটা নিজের হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে চুপ হয়ে যেত। দুজোড়া চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি একটি বিন্দুতে এসে মিলত।

এভাবেই সকলের নজরের আড়ালে প্রতিদিনের বিকেল কাটানোর মধ্যে দুটি প্রাণের সব সংকোচ, আপনাকে সংবরণের সব ইচ্ছা, লজ্জায় কেটে যাচ্ছিল। ওদের মধ্যে ঠিক কী ছিল—মায়া, নাকি ধোঁয়াশা রঙের খানিকটা অনুভূতি?

চলবে…

শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়