ক্রিপ্টোনিয়ান রবিন হুড

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

শ্রাবণ মাস শেষ হতে না হতেই আকাশ ভেঙে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। ধুলো ঝেড়ে ডায়েরিটা খুঁজে বের করলাম। এই ডায়েরিতে পুরোনো প্রেম মরে পড়ে আছে আর জীবনের যাবতীয় হতাশা আর কটাক্ষ নিয়ে তাকিয়ে থাকা ব্যর্থতা। সুখের সময় যার জীবনকে কখনো ধন্য করেনি, তার জীবনে অসুখেই ডায়েরিটা আপন হবে—এমনটাই স্বাভাবিক।

কত হিজিবিজি স্মৃতি, ভুলতে না চাওয়া প্রেমের অপ্রাপ্তি আর বিচ্ছেদের চিত্র এঁকে এঁকে বড় হয়েছি—ডায়েরিটা সাক্ষ্য দিচ্ছে ক্রমেই ফুলে-ফেঁপে। বহুদিন স্পর্শ পায়নি আমার। শেষ দিন যা লেখা হয়েছিল, ওতে হৃদয়স্পর্শী কিছু লাইন—
‘হারাবার আর কিছুই নেই। বুকের ভেতর শুকনা মচমচে ঝরা পাতা। অজানা কষ্টের ভারে মচমচ শব্দে গুঁড়ো হয়। খুব সুন্দর একটা জীবন ছিল। সুন্দর এক জগৎ ছিল। ওখানে সন্ধ্যা নামলে পাতারা ঝিমাত, ভোরবেলা তাদের ঘুম ভাঙত পরম শান্তিতে। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কান্নায় ভেসে যাচ্ছে সব। বালিশটা চুপসে আছে ভিজে। হতাশা গলা চেপে ধরেছে। এর জন্য দায়ী আমিই। আকাশ মেঘলা, ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কালই বিচ্ছেদ হয়েছে। আজ জিজ্ঞেস করলাম তাকে...।’

এ অবধি লেখা। কী জিজ্ঞেস করেছি, কেন করেছি তা মনে নেই। ডায়েরিটা ঘৃণাভরে রেখে দিলাম। মানুষ যাকে ভালোবাসে, তাকে কখনো ঘৃণা করতে পারে? হয়তো পারে। মানুষের পক্ষে সব সম্ভব।

সে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যাবে। তারপর হঠাৎ চেয়ে দেখবে আমি নেই। তার বুকটা সহসা শূন্য হয়ে যাবে। আর আমার এই শূন্যতা মেখে সে ফিরে আসার পথ খুঁজবে।

এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে খুব জীবনানন্দের কবিতা পড়তে ইচ্ছা করছে। প্রকৃতির এত চমৎকার বর্ণনা যে মানুষটা দিতে পেরেছেন, তিনি কেন বৃষ্টি নিয়ে কিছু বলেননি, ভেবে অবাক লাগছে। কেন লেখেননি এই ঋতু নিয়ে, তার উত্তর খুঁজে বের করলাম খুব ভেবে। এক. বর্ষা এত মধুর সময় যে তা উপভোগ করতে করতে কবিতা লেখার ফুরসতটুকু কবি পাননি। দুই. শ্রাবণ সবার হৃদয়ে স্থান পায় না।

মুষলধারে বৃষ্টি হলেই ভেজার জন্য মন কেমন করে। কিন্তু একজন আছে, যে বলেছে তাকে ছাড়া ভেজা যাবে না একলা। জ্বর হলে কে যত্ন করবে আমার! তাই একা ভেজা নিষিদ্ধ। নিজেকে সামলে নিয়ে মানুষটার অপেক্ষা করি। হঠাৎ হঠাৎ এসে আমায় চমকে দেয় সে। তারপর হঠাৎ ডুব। তিন-চার দিন, কখনো কখনো আরও বেশি সময় ধরে উবে যায়। কোথায় যায়, কেন যায়, আমায় ছেড়ে কেমন করে থাকে—কোনো উত্তর নেই আমার কাছে। তবু আমি উত্তর ভেবে নিই। মনে হয়, সে কাজ করছে, খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, আমার ভাবনা তার পিছু ছাড়ছে না। একলা থাকার সময়টায় আমি গিয়ে মিষ্টি করে হেসে ঠোঁট কামড়ে বলি—‘যখন ঠোঁটের মাঝে গল্প এসে জমে, মানুষ তখন চুমু খায়। আপনারও কি জমেছে?’
সে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যাবে। তারপর হঠাৎ চেয়ে দেখবে আমি নেই। তার বুকটা সহসা শূন্য হয়ে যাবে। আর আমার এই শূন্যতা মেখে সে ফিরে আসার পথ খুঁজবে। এই আগমন–প্রস্থানের ফাঁকে প্রেম জমে তীব্রভাবে। আমি আর কিছু ভাবার অবকাশ পাই না।

বই খুলে বসলাম। কয়েক পাতা পড়ে ঝিম ধরে বসে আছি। নীলাভ ফোনের স্ক্রিনে হঠাৎ একটা মেসেজ চোখে পড়ল।

ফোনের আনাচকানাচে বহু অপশন আছে। সবগুলো আমার জানা নেই। সাবিহা একদিন বলেছিল, মেসেঞ্জারে মেসেজ রিকোয়েস্ট বলে একটা অপশন থাকে। সেদিনই চিনেছিলাম। গিয়ে দেখি গুনে গুনে আটান্নটি মেসেজ। অধিকাংশই হাই-হ্যালো। ফেক আইডি গিজগিজ করছে। মনে মনে ভাবলাম, সবগুলো মানুষ যদি সামনে থাকত আর আমি স্টেজে উঠে একে একে উত্তর দিতাম তাদের, বিষয়টা হয়তো চমকপ্রদ হতো। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিজেকে সেই অবস্থায় ভেবে নিয়ে মুচকি হাসলাম। একজন লিখেছে, ‘এই মেসেজটি ২০ জনকে ফরোয়ার্ড না করলে বিপদ ঘনিয়ে আসবে তিন দিনের মধ্যেই!’ তারিখ চেক করে দেখি বছরখানেক আগের মেসেজ। তিন দিন যে ওভার হয়ে গেছে এবং শামসুল সাহেবের অকপট অহংকার নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছি, তা আর বলার প্রয়োজন বোধ না করে হো হো শব্দে হাসলাম কিছুক্ষণ। হাসতে হাসতেই মনে পড়ল তাকে। ভেবে রাখলাম, সে এবার এলে বলব এত গম্ভীর না থেকে একটু হো হো করে হাসতে। যেন বিয়ের পর আমাদের ছেলে অনির্বাণ এসে আমায় ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘মা, বেডরুমে কে ডাইনোসরের মতো হাসছে?’

বহু মেসেজ পেরিয়ে একটা মেসেজে চোখ পড়ল। মানুষটার ওয়ালে লেখা বুকোওয়েস্কির বাণী—‘ইউ হ্যাভ টু ডাই আ ফিউ টাইমস বিফর ইউ ক্যান রিয়েলি লাইভ’।
আমি তখন চার্লস বুকোওয়েস্কির ‘পোস্ট অফিস’ পড়ছি। তাই কৌতূহলবশত রিপ্লাই দিলাম। মানুষটা দিন দুই পর অনলাইনে এল। অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলে বসল, ‘আপনাকে খুঁজে পেতে যে চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে, তার জন্য হলেও হুমায়ূন আহমেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ব্যাপারে সাহায্য করুন।’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মানে?’
: হিমু-রুপার মিলন কেন হয় না? আমার খুব কষ্ট হয়।
: এ বাবা! এতেই এত দুঃখ পেলে চলবে?
অস্বস্তির একটা ইমোজি আঁকল সে। বলল,
: আমি না হয় পেলাম না আপনাকে, কিন্তু রুপা হিমুকে যে প্রতিনিয়ত না পাওয়ার যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়, এটা মানতে ভীষণ কষ্ট হয় আমার।

আরও পড়ুন

যারপরনাই বিস্মিত হলাম। আইডির নাম বলছে তিনি একজন মেয়ে। কিন্তু আদতে ওপারের মানুষটা ছেলে! শুধালাম, ‘মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রয় কোন যুধিষ্ঠির?’
সে হেসে উত্তর দিল, ‘এ আমার অল্টার ইগো। আসল জন ক্রিপ্টোনিয়ান রবিন হুড। স্যাড, টায়ার্ড...ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি মানুষকে দেখি দূর থেকে। বন্ধু হবেন মিস?’
: পাণিপ্রার্থী হওয়ার বদলে বন্ধুত্ব চাইছেন! হৃদয় না সান্নিধ্য প্রয়োজন?
: ভালোবাসা চুমু নয় যে একা বাসা যায় না। থাক, ওসব ভাবতে হবে না। কেবল আপনি থাকলেই চলবে। আপনার মতো মানুষের হৃদয় পাওয়ার সৌভাগ্য বা চাওয়ার দুঃসাহস কোনোটাই নেই।
আমার উদাসী মনে দোলা লাগল তার কথায়। আমি ঠিক এমনই একজনকে আজীবন চেয়ে এসেছি যেন। ধাতস্থ হয়ে বললাম,
: হিমু-রুপার মিলন ঘটালে খুশি হবেন?
সে উৎফুল্ল হয়ে উঠল।
: সত্যি? সত্যি লিখবেন আপনি? উফ! জানেন, কয়বার বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। প্লিজ মিলিয়ে দিন ওদের। আমার খুব দুঃখ হয় রুপার জন্য।
আমি ভারাক্রান্ত মনে লিখলাম, ‘মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল।’
: ওসব আমার ক্ষেত্রে হোক মিস। ওদের জন্য প্লিজ একটা গল্প লিখুন। ওতে ওদের মিলন হবে। এতে আমি ভীষণ খুশি হব ম্যাডাম।

মানুষটা অদ্ভুত। গভীর রাতে তার সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছিল চাঁদের আলো-আঁধারিতে নিজের ছায়ার সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তর, যুক্তি আর দর্শন নিয়ে লুকোচুরি খেলছি। উত্তরের সমাপ্তি নেই ঠিকঠাক। কথার গন্তব্য নেই। এ যেন হৃদয়ের তৃষ্ণা বাড়ায় ক্রমেই। কিন্তু ঠিক কী চায় মন, তা বোঝে না। বোঝার উপায় রাখে না।
প্রশ্ন করলাম, ‘কবিতা ভালো লাগে?’
: সবচেয়ে বেশি।
: আমাকে চান?
: কেবল সান্নিধ্য।
আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম আমার বুকে হাহাকার এসে জমছে। শুনেছি মানুষের জীবনে বিশেষ কিছু মুহূর্ত থাকে। ঠিক সে সময়গুলোকে লাকি মোমেন্ট বলা হয়। যে হৃদয় পাষাণসম, সে হৃদয় সেই লাকি মোমেন্টে সামান্য স্পর্শ করলেই গলে যাবে। আমার কি সেই তিথি চলছে?
: ভালোবাসা চান না কেন?
: আমায় কেন ভালোবাসবেন আপনি?
স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রইলাম। উত্তর নেই। কেবল লিখলাম, ‘হিমু-রুপার মিলন হবে। আপনার জন্য লিখব আমি।’
সে হুড়োহুড়ি করে উত্তর দিল, ‘না না, প্লিজ আমার জন্য বলবেন না। আমি কে! আপনি লিখবেন সবার জন্য। লেখক কারও একার হয় না। আর প্লিজ এটা কাউকে দেখাবেন না আমায় ছাড়া। অন্য কেউ মিলন দেখুক, আমি চাই না।’
বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
সে উত্তর না দিয়ে অনুরোধ করল। আমি মাথা ঝাঁকালাম।

আরও পড়ুন

পেনকেসে ধুলো। প্রেমিককে নিয়ে প্রতিদিন লেখা হয়। সব ফোনেই লিখি। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের চরিত্র নিয়ে কাজ করতে হলে কাগজ-কলম ছাড়া চলবে না। চোখ বন্ধ করে ভাবছি। হিমুর গায়ে কটকটে হলুদ পাঞ্জাবি। পকেট নেই। রুপা নীল শাড়ি পরে গালে হাত দিয়ে ছাতিমগাছ দেখছে। ছাতিমের ডালে দুঃখ থাকে। রুপা জানে না।হিমু রুপাকে দেখতে আসছে। মাঝপথে হিমুর মনে পড়বে তার জরুরি কাজ আছে। সে ছুটে যাবে ময়ূরাক্ষী নদীর কথা ভাবতে। পা ডুবিয়ে বসে থাকবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রুপার দুঃখ বাড়বে। তারপর একদিন শ্রাবণের শেষ রাতে হিমুর মনে হবে রুপাকে তার প্রয়োজন। কিন্তু মহাপুরুষ হতে হলে যেমন একনাগাড়ে মিথ্যা বা একনাগাড়ে সত্যি বলতে হয়, তেমন করে নারী সান্নিধ্য পাওয়াও তাদের মানায় না। বেশ কঠিন ব্রত। বাস্তবতা এড়িয়ে চলবে সে। কিন্তু বাস্তবতা তাকে এড়িয়ে চলবে না বলেই হিমুর ভীষণ প্রেম পাবে বছর শেষে। রুপার মনের বিষণ্নতার করিডর মাড়িয়ে হিমুর চুপচাপ প্রবেশ। রুপার চোখে বাঁধভাঙা কাকচক্ষু জল। নেপথ্যে ভালোবাসার গান। আমার এলভিস প্রিসলির গানের কথা ভাবতে ইচ্ছা হচ্ছে। পাঠকেরা সুবিধামতো গানের কথা ভাবতে পারেন। এরপর দরজায় খিল। ভেতরে তীব্র প্রেমের আকুতি আর আনন্দ ধ্বনি।

এ অবধি পড়ে পাঠকের চোখে খুশির জল। তাঁরা উঁকি দিয়ে রুপা আর হিমু রুমের ভেতর কী করছে তা দেখার চেষ্টা করবেন। কিন্তু ঝাপসা চোখে কি কিছু দেখা যায়?
এ পর্যন্ত ভেবে হাসতে লাগলাম। কী উন্মাদের মতো চিন্তাভাবনা আমার! আমি হিমু হলে এসব ভাবনা বাদ দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তাম। টংদোকান থেকে চা নিয়ে খেতাম। বিল দিতাম না। তারপর হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাতে বসে থাকা হকার চাচাকে জোকস শুনিয়ে এই যাবতীয় জমানো হাসির পসরা বসাতাম। হো হো শব্দে বিক্রি হতো হাসি। হাসি জিনিসটা হলো সংক্রামক। একসময় এভাবে দেশের সব মানুষ হাসতে থাকত। চোখ বন্ধ করে কল্পনা করছি, দেশের সবাই কিম্ভূতকিমাকার ভঙ্গিতে হো হো করে হাসছে। কুমড়ো পটাশের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে হাসছে। কী মজার দৃশ্য!

আমার প্রেমিক কল দিল। তাকে পেয়ে মনটা শান্ত হলো ক্ষণিকের জন্য। হঠাৎ মাথায় এল, সে কি ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ পড়েছে? জিজ্ঞেস করলাম না। উত্তর আমার জানা। সংগত কারণেই সাধারণ প্রেমিকার মতো জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভালো থাকা হয় আমায় ছাড়া?’

আমার মগজে শীতল স্রোত। মাথায় ঘুরছে—‘আমাদের মিলন না হোক, হিমু-রুপার মিলন চাই।’ কলম ধরে বসে আছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক বিন্দুও লিখতে পারিনি। মানুষটার জন্য একপ্রকার টান অনুভব করছি, যা আমার জন্য নিষিদ্ধ। একটা পুরোনো গান নেপথ্যে বাজছে মগজের—
‘কেন এত ভয় ভয় করো
আসো না আমার কাছে,
তুমি তো জানো না কত কথা এই
অন্তরে জমা আছে।
সাত পাঁচ ভেবে ফিরে যাই আমি
আসি না তোমার কাছে।
নিন্দুকেরই কলঙ্ক হায়
পাও যদি তুমি পাছে...’

হাহাকার আর শূন্যতা গ্রাস করল। কথাটা রাখতে পারলাম না আমি তার। হিমু-রুপার মিলন গল্পে যেমন হয় না, বাস্তবেও তেমন হয় না—এ কথা তাকে বলার দুঃসাহস আমার আর হলো না।

উঠে আয়নার সম্মুখে দাঁড়ালাম। নিজের প্রতিচ্ছবিকে শুধালাম চিরকালীন রাবীন্দ্রিক প্রশ্ন— সখী, ভালোবাসা কারে কয়?