শ্রেয়ার পছন্দের কবিতা ‘টেলেক্স’ আবৃত্তি করছে রুদ্র। ঝংকারের লালিত্যে নিবিষ্ট মনের নিমিলিত চোখে উপস্থিত সবাই যেন একমুহূর্তে হারিয়ে গেল সেই পাহাড়ের চূড়ায়।
সজ্জিত গ্যালারির ওপর-নিচে কানায় কানায় ভরপুর হয়ে গেল। কোথাও কারও সাড়াশব্দ নেই; পিনপতন নীরবতা গ্যালারিজুড়ে। শতাধিক মানুষ উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শোভন মঞ্চের দিকে। শ্রেয়া অর্ধখোলা পিঠে বসে আছে সামনের সারিতে। ছিমছাম ব্লাউজের সঙ্গে পরেছে নীল রঙের শাড়ি। এসিতে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার কারণে শিউরে ওঠে ক্ষণিক। সেফটিপিনে কাঁধে ঝোলানো শাড়ির লম্বা আঁচল টেনে টাল সামলে নেয়। দর্শকদের সম্মুখে ধীরে উঠে গেল মঞ্চের পর্দা। একাগ্রচিত্তে চতুর্দিক থেকে আলো এসে নিবিষ্ট হলো ডায়াসের ওপর। গ্যালারির জাজ্বল্যমান সব বাতির আলো উল্কা পতনের মতো ধীরে মিইয়ে গেল।
সঞ্চালকা সম্মোহনী কণ্ঠে শুরু করল, ‘শুভসন্ধ্যা! কবিতার আসরে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। পৃথিবীতে কবিতাকে বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন নামে ও অভিধায় সম্বোধন করা হলেও কবিতার একটা সুন্দর নাম আছে। সেটি হলো “কবিতা”। এ পর্যায়ে আবৃত্তি করবেন বাচিক শিল্পী ও আবৃত্তির প্রশিক্ষক রুদ্র রায়।’
রুদ্র মঞ্চের পেছন থেকে এসে বলতে শুরু করে—
‘মালতী শুনতে পাচ্ছ? এখানে বৃষ্টি শেষে
কুয়াশা জমে, পাহাড়ের চূড়ায়।
এখানে কাঁঠালিচাঁপা নেই, আছে বুনো ফুল।
অভিধান থেকে নয়, আমি এখানে প্রকৃতি থেকে ভালোবাসার শব্দটি খুঁজে পাই।’
শ্রেয়ার পছন্দের কবিতা ‘টেলেক্স’ আবৃত্তি করছে রুদ্র। ঝংকারের লালিত্যে নিবিষ্ট মনের নিমিলিত চোখে উপস্থিত সবাই যেন একমুহূর্তে হারিয়ে গেল সেই পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে পাহাড়ের বুক দখল করেছে কুয়াশা ও মেঘরাশি। রুদ্রের ছন্দের মধুরতায় সবুজ ও সৌন্দর্যের মিলনে মিশে গেল শ্রেয়াও। আবৃত্তির আবেশে এখনো চোখজোড়া মুদে রইল।
রুদ্রের বোধের জগৎ বিস্তীর্ণ। কবিতাকে হৃদয়ের গহিনে লালন করে গভীর আলিঙ্গনে। যদিও প্রতিটি সেশনে রুদ্রকে শোনার সুযোগ হয় শ্রেয়ার; তবে ‘টেলেক্স’ কবিতাটি এত সুন্দর আবৃত্তি করবে, তা ভাবনায় ছিল না। গলায় এত দরদ! রুদ্র ভারী গলায় এমন সুধার মতো শব্দের উচ্চারণ করে! ওর এমন রূপ আগে কখনো দেখেনি শ্রেয়া। সুরের লহরীর সুই–সুতায় গেঁথেছে শতাধিক উৎসুক দর্শকের আবেগ। গ্যালারিজুড়ে নীরবতার শামিয়ানা ভেদ করে শ্রবণেন্দ্রিয়ের জিহ্বা যেন ছন্দব্যঞ্জনার রস চেটেপুটে খাবে এমন স্পৃহায়।
রুদ্রের আবৃত্তির শিক্ষার্থী শ্রেয়া। বয়সের বিশদ পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। শ্রেয়া ললিত কলা থেকে পাস করেছে বছর দেড়েক আগে। ছাপচিত্রে ও সিদ্ধহস্ত। কবিতার প্রতি প্রবল ভালোবাসা থেকেই শিল্পকলা একাডেমিতে রুদ্রের কাছে শিখতে আসে প্রতি সপ্তাহে বন্ধের দিনগুলোয়। শ্রেয়াকে কসরত করে শেখাতে হয়নি রুদ্রের। শব্দের প্রমিত উচ্চারণে ওর জিহ্বা ছিল ক্ষুরধার। কেবল মাইক্রোফোনের সঠিক ব্যবহারটা শিখিয়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে আবৃত্তি নির্মাণ শিখে গেছে শ্রেয়া। এখন আর শিখিয়ে দিতে হয় না মাইক্রোফোনের কিসিং ডিসট্যান্স বা লিপ টাট, ওপর-নিচ, কাছে–দূরে সব টাল সামলে নেয় একাই। ওদের ব্যাচের আবর্তন শেষ হয়েছে সেই কবে, তবু নিয়মিত শিল্পকলায় আসে ও। কবিতা আবৃত্তির জন্য নয়, রুদ্রকে শোনার জন্য। রুদ্রের প্রতি অদৃশ্য এক ভালোবাসা তার। সেই অদৃশ্য শক্তির ওপর ভর করে চলে নিয়মমাফিক। রুদ্র যেন নাগমণি, এক রহস্যময় রত্ন। সেই রহস্যময়তার ঘোর সাপের মতো টেনে আনে শ্রেয়াকে।
শিল্পকলা একাডেমির অনুষ্ঠানসূচি অনুযায়ী শ্রেয়া আজও এসেছে কবিতার আসরে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাবের প্রগাঢ়তা ও সীমাহীন উন্মাদনা নিয়ে গোগ্রাসে কবিতা গিলেছে। সঙ্গে রুদ্রকেও দেখেছে পুরোনো খামে নতুন চিঠির মতো। একেবারে ওলটপালট করে দেখছে আপাদমস্তক। আজকাল রুদ্রের চলন-বলন শ্রেয়ার শয়ন-স্বপনের মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে।
আসর শেষ হলে যে যার মতো সটকে পড়ে। ততক্ষণে বিনা কারণে মুখ কালো করে আকাশের বুক চিরে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। শ্রেয়া গ্যালারির দরজার সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। রুদ্র মঞ্চের টুকিটাকি কাজ সেরে বের হয়েছে। শ্রেয়াকে দেখে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘আপনি এখানে এতক্ষণ কী করছেন?’
সে নিরলস গলায় উত্তর দিল ‘অপেক্ষা’।
‘মানে?’ তাজ্জব বনে যাওয়া গলায় বলে ওঠে রুদ্র।
‘জি, আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা অনুরোধ করতে পারি?’
‘জি, নিশ্চয়ই।’
‘এই বৃষ্টিতে আমার বাসায় যেতে একটু সমস্যা হবে। যদি আপনি একটু...’
রুদ্র একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেও ঝুমবৃষ্টির বিজন নিশীথে বিষয়টি কেমন যেন ঠেকে তার মনে।
গেটের সামনে থেকে একটা সিএনজি ডেকে নেয় শ্রেয়া। ‘মামা, যাবেন?’ গাড়ি থামলে বাছবিচার না করে উঠে পড়ে গাড়িতে, সঙ্গে রুদ্রও।
চালক বলল, ‘কোথায় যাবেন?’
দরাজ গলায় শ্রেয়া বলে, ‘আপনি টানুন...’
‘কিন্তু কোথায় যাব?’
শ্রেয়া মৃদু ধমকের সুরে বলে, ‘আরেহ্, আপনাকে টানতে বলছি; আপনি গাড়ি টানুন।’
বৃষ্টির গাঢ় বুক চিরে নীরবে এগোতে থাকে গাড়ি। বৃষ্টির ছাঁট থেকে রক্ষায় মোটা ত্রিপল টেনে দিয়েছে দুপাশে। তবু বাতাসে পতপত করে উড়ছে দুপাশ। বাতাসের ঝাপটায় ওদের ভেজা শরীরে মৃদু কাঁপন ধরে। শ্রেয়া আরেকটু সরে এসে একেবারে পাশ ঘেঁষে বসেছে রুদ্রের। বগলদাবা হয়ে বসেছে যেন শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। গাড়ি চলছে উদ্দেশ্যহীন অজানা গন্তব্যের পথ ধরে। বৃষ্টিতে ব্যস্ততম নগরীর চওড়া রাস্তাও ফাঁকা, কেবল দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ ল্যাম্পপোস্টগুলো। শরীরের ওমে দুজনের আধভেজা শরীর কখন যে উষ্ণতায় পরিপূর্ণ হয়েছে, সে খেয়াল নেই কারও। শ্রেয়া অবচেতনে রুদ্রের কাঁধে মাথা রেখে সুখাকর চোখে ঘুমিয়ে পড়ে। আবৃত্তির আবিষ্টতায় উপমার বাস্তবতায় হারিয়ে গেল পাহাড়ের শিখরে।
সেই স্বপ্নীল সুউচ্চ পাহাড়রাশির চূড়ায় সুনির্মল মেঘপুঞ্জের ছলচাতুরী খেলায় সৌন্দর্য বেড়ে গেল কয়েক গুণ। শ্রেয়ার নীল রঙের শাড়ি আর রুদ্রের সাদা পাঞ্জাবিতে নির্জন পাহাড়ের চূড়া স্বপ্নীল মনোহারী। উদাস মনে শ্রেয়া আঁচল বিছিয়ে হাঁটছে ছেয়ে থাকা সবুজের সায়রে। রুদ্র দেখছে দূর থেকে, শ্রেয়ার চঞ্চল মনে এতটুকু ভয় নেই পা পিছলে নিচে তলিয়ে যাওয়ার। ঘোলাটে আকাশের চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে ধারাজল। শ্রেয়া ভিজছে দুহাত প্রসারিত করে ঊর্ধ্বপানে চেয়ে। নীল শাড়ি ভিজে জবজব হয়ে শ্রেয়ার অনাবৃত শরীরে লেগে আছে। ধবধবে সাদা শরীরের উতলা বুক পুলকিত হয়ে আছে বৃষ্টির পীযূষ ছোঁয়ায়। সুকুমার পদচালনায় পেছনের দিক থেকে রুদ্র এসে জড়িয়ে ধরে; উষ্ণতায়, ভালোবাসা ও অনুরণনের প্রগাঢ়তায়।
অকস্মাৎ একটা ঝটকায় রুদ্রের কাঁধ থেকে মাথা সরে গিয়ে ঘুম ভেঙে গেল শ্রেয়ার। চালক জোরে ব্রেক কষে থেমে গেল। শ্রেয়ার চোখেমুখে ঘোর লেগে থাকে তখনো। বৃষ্টিবাদলায় রুদ্রের ওমে স্বপ্নময় মুহূর্ত শেষ হয়। রুদ্র নিশ্চুপ বসে আছে; শ্রেয়া এতক্ষণে হারিয়ে গেছে স্বপ্নের অতলে।
চালক সীমাহীন বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা অজানা পথ ধরে চলতে লাগলাম, কিন্তু কোথায় যাবেন, বলুন এবার।’
রুদ্র বলল, ‘মামা কিছু কিছু দিন উদ্দেশ্যহীন, একেবারে মাতাল হওয়ার মতো। কোথায় যাচ্ছি, জানি না। তবে কোথাও না কোথাও তো যাচ্ছি।’
শ্রেয়া সকৌতুক রুদ্রের দিকে তাকিয়ে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘সুখের মুহূর্ত কি এত সংক্ষিপ্ত হয়? চাইলে কি আরেকটু স্থায়ী করা যায় না? নাকি নশ্বর পৃথিবীতে সুখের আয়ু ক্ষীণ?’
রুদ্র কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। একেবারেই নিশ্চুপ।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা