কফিন মিছিল ও ৩৬০ মিনিট

কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে নিহত শিক্ষার্থীদের গায়েবানা জানাজা শেষে কফিন মিছিল বের করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাছবি: সাজিদ হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি চত্বরে। ১৭ জুলাই ২০২৪

‎১৭ জুলাই ২০২৪। বেলা দুইটায় আমরা দুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দিই। সেখানে আগের দিনে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হওয়া ছয়জন শহীদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

‎আমি থাকি সাভারের হেমায়েতপুরে। বাসে চড়ে নিউমার্কেটে চলে যাই। ততক্ষণে আমার ক্যাম্পাস ঢাকা কলেজের সব কটি গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। হেঁটে চলে যাই নীলক্ষেত গণতন্ত্র তোরণের সামনে, পুলিশ কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কটি প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তারাই ভেতরে যেতে পারবে, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং উপযুক্ত কারণ দেখাতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড দেখাতে হবে। যেহেতু আমরা ছিলাম ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী, তাই কোনোভাবেই পুলিশ ভেতরে যেতে দিল না। আমি এবং আমার বোনের ছেলে ইব্রাহিম দুজন সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম।

‎কিছু সময় পর দেখতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে শিক্ষার্থীরা ছোট্ট একটা ঝটিকা মিছিল নিয়ে বের হয়ে আসছে। তাদের মুখে আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো স্লোগান—
‘আমার ভাই মরল কেন? প্রশাসন জবাব চাই!’
‘ক্যাম্পাসে পুলিশ কেন? প্রশাসন জবাব চাই!’
‘পুলিশ দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না!’
‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত। রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়!’
‘ক্যাম্পাস আমাদের বাড়িঘর, ক্যাম্পাস আমরা ছাড়ব না!’

এ রকম নানা স্লোগান বের হচ্ছিল ছাত্রদের মুখ থেকে। তারা এসেছিল কফিন নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি এবং ইব্রাহিম একটা সুযোগ পেয়ে মিছিলের সঙ্গে জুড়ে যাই। কফিন নিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করি। কিন্তু মিছিলটি যেহেতু ছোট ছিল, পুলিশ আমাকে চিনে ফেলে এবং আটকানোর চেষ্টা করে। আমি পুলিশকে ধাক্কা দিয়ে দৌড় দিই। সঙ্গে সঙ্গে মিছিলে মিলিত হয়ে যাই। সম্ভবত এই মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রিফাত রশিদ ভাই।

‎শিক্ষার্থীরা কফিন নিয়ে চলে আসে ভিসি চত্বরে। সেখানেই অনুষ্ঠিত হবে গায়েবানা জানাজা। শুনেছি গায়েবানা জানাজা হওয়ার কথা ছিল রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে। সেখানে পুলিশের বাধায় সম্ভব হয়নি, তাই স্থান পরিবর্তন করে ভিসি চত্বরে নিয়ে আসা হয়।

যে কফিনের সঙ্গে নীলক্ষেতে যুক্ত হয়েছিলাম, সেটি আমরা প্রকাশ্যে ভিসি চত্বরে নিয়ে আসতে পারলেও, বাকি কফিনগুলো পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। তাই সেগুলোকে নিয়ে আসা হয় অ্যাম্বুলেন্সে করে। ছয়টি কফিন এসে পৌঁছায়, যদিও শুনেছিলাম সাতজন শহীদের জন্য সাতটি কফিন থাকার কথা ছিল। তার মধ্যেই বুয়েটের দিক থেকে আরও একটি বড় মিছিল এসে যুক্ত হয় চত্বরে।

আরও পড়ুন

ক্যাম্পাসের ভেতরে টহল দিচ্ছিল পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, সোয়াট টিম এবং কয়েকটি সাঁজোয়া যান। মনে হচ্ছিল যেন এটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র।

‎কিছুক্ষণ পরে সমন্বয়ক নাহিদ ভাই বক্তব্য দেন। শহীদদের নাম ও নিহতের স্থান উল্লেখ করেন। তারপর শুরু হয় গায়েবানা জানাজা। ইমামতি করেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তারেক রেজা ভাই।

‎নামাজ শেষে কফিন মিছিল নিয়ে স্লোগান দিয়ে ভিসি চত্বর থেকে টিএসসির অভিমুখে রওনা হই। সেখানে পুলিশের প্রথম বাধার সম্মুখীন হলে ছাত্ররা সেই ব্যারিকেড ভেঙে সামনের দিকে এগোতে থাকে। তারপর আবার দ্বিতীয় বাধার সম্মুখীন হই। ছাত্ররা যখনই দ্বিতীয় ব্যারিকেড ভেঙে সামনে এগোনোর চেষ্টা করে, তখনই মুহুর্মুহু কাঁদানের গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, ককটেল নিক্ষেপ করতে থাকে। সবাই দিশাহারা হয়ে যায়।

‎ছাত্ররা চেষ্টা করে পেছনের দিকে যেতে, কিন্তু পুলিশ ভিসি চত্বরের দিক থেকেও কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড মারতে থাকে। পুলিশের আক্রমণের কিছুক্ষণের মধ্যেই ইব্রাহিমকে হারিয়ে ফেলি। পুলিশের দ্বিমুখী আক্রমণের কারণে ছাত্ররা কোনো উপায় না পেয়ে কেউ কেউ কলাভবনের বাউন্ডারির উঁচু দেয়াল টপকে পালানোর চেষ্টা করে। সেখানেই অনেক ছেলেমেয়ে আহত হয়। সবাই এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। ততক্ষণে কাঁদানে গ্যাসের জ্বালায় চোখ, নাক, মুখ পুড়ে যাচ্ছিল। কোনো উপায় না পেয়ে রাস্তার বিপরীত পাশে সাংবাদিক দেখে তাঁদের দিকে দৌড়ে যাই। একটি কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে পড়ে আমার পায়ের কাছে। পুলিশ সেখানেও আক্রমণ করে। সেদিন কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হয়েছিলেন।

কাঁদানে গ্যাসের শেলের গ্যাসে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলাম। একজন সাংবাদিক আমাকে কলাভবনের পকেট গেটটা দেখালেন। আমি আবার রাস্তা পার হয়ে পকেট গেট দিয়ে অপরাজেয় বাংলার দিকে দৌড়াতে লাগলাম। চোখের জ্বালাপোড়ার জন্য ঠিকমতো চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম না। অপরাজেয় বাংলার দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে দেখলাম রাস্তায় মাঝে অনেক মেয়ে পড়ে আছে। কেউ কেউ বমি করছে। তারা দৌড়ে বেশি দূর যেতে পারেনি। কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর আমি রাস্তায় পড়ে যাই। এক ভাই এসে আমাকে তোলেন। তিনি আমার মুখে টুথপেস্ট লাগিয়ে দেন। একটা কাগজে আগুন ধরিয়ে আমার নাকে-মুখে ধোঁয়া দেন।

কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে নিহত শিক্ষার্থীদের গায়েবানা জানাজা শেষে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কফিন মিছিল বের করলে পুলিশ মিছিলটি লক্ষ্য করে একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার সেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে
ছবি: সাজিদ হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসি। ১৭ জুলাই ২০২৪

‎কিছুক্ষণ পর কাঁদানে গ্যাস থেকে একটু রিলিফ পেলে অপরাজেয় বাংলায় এসে সম্ভবত হাসনাত ভাইকে পড়ে থাকতে দেখি কাঁদানে গ্যাস খেয়ে। আমি তখনো হাসনাত ভাইকে ঠিকঠাক চিনতাম না। ‎হলপাড়ায় ছাত্ররা শুকনা পাতা, কাঠ জোগাড় করে জায়গায় জায়গায় আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া ছড়াতে থাকে। একজনকে দেখলাম আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে। তাঁকে একটা রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। তিনি সম্ভবত হান্নান মাসউদ ভাই ছিলেন।

পুলিশের প্রথম আক্রমণের সময়ই ইব্রাহিমকে হারিয়েছিলাম। আমি একের পর এক কল দিতে থাকি, কিন্তু ওর ফোনে কোনোভাবেই সংযোগ হচ্ছিল না। চিন্তা ক্রমেই বাড়তে থাকে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর দূর থেকে দেখি ও অপরাজেয় বাংলা থেকে হলপাড়ার দিকে এগিয়ে আসছে। একজনের কাছে ফোন চাইছে। দৌড়ে ওর কাছে যাই। ওকে সুস্থ দেখে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পাই। জিজ্ঞেস করি, ‘ফোন বন্ধ কেন?’ জানায়, ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে।‎

‎কিছুক্ষণের মধ্যেই হলপাড়া থেকে ছাত্ররা একটা-দুইটা গাছের ডাল ভেঙে ইটপাটকেল জোগাড় করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। ভিসি চত্বরে আবার কিছু ছাত্র জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকে পুলিশ এবং বিজিবিকে উদ্দেশ করে।

‎আমরা সেদিকে যাই। কিন্তু পুলিশ এবার কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেডের পাশাপাশি রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। সেখানে টিকতে পারিনি, দৌড়ে ছুটে আসি সূর্য সেন হলের দিকে।

তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। পুলিশ ভিসি চত্বর থেকে কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ছুড়ে ক্ষান্ত থাকেনি। তারা হলের দিকে আক্রমণ করে এগিয়ে আসছিল মল চত্বর দিয়ে। কিছু কিছু ছাত্র ব্যাগ-বই নিয়ে হল ছেড়ে পালাচ্ছিল মুহসীন হলের রাস্তা দিয়ে। আন্দোলনরত ছাত্ররা তাদের বোঝাতে চেষ্টা করে, যাতে কেউ হল ছেড়ে না যায়। কিন্তু তারা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়।

‎পুলিশ যখন কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট মারতে মারতে মল চত্বর দিয়ে হলপাড়ার দিকে এগিয়ে আসছিল, কেউ কেউ বলছিল, সূর্য সেন হলের ভেতরে আশ্রয় নিয়ে হলের গেট ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়ার কথা। তখন ভয় পেয়ে যাই। যদি হলের ভেতরে আটকা পড়ে যাই, তাহলে হয়তো মারাত্মক সমস্যায় পড়ে যাব। যেহেতু আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নই। ইব্রাহিম বলছিল, ‘আমরা যদি হলের ভেতরে আটকা পড়ে যাই, তাহলে বড় বিপদ হবে। রাতে ছাত্রলীগ হামলা করতে পারে!’

আরও পড়ুন

‎একে একে অনেক ছাত্রই হল ছেড়ে চলে গিয়েছে। পুলিশ যেতে বাধ্য করেছে। আমরাও উপায় খুঁজতে থাকি কীভাবে এখান থেকে বের হওয়া যাবে। যেসব ছাত্র হল ছেড়ে যাচ্ছিল, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মুহসীন হলের গেট দিয়ে বের হয়ে আসি মেইন রোডে। আমাদের দুজনের মাথায় পতাকা বাঁধা ছিল। আমি বললাম, ‘পতাকাটা খুলে পকেটে রাখ, আক্রমণের আশঙ্কা আছে!’
ইব্রাহিম শুধু বলল, ‘দেখ, আজকে তুই দেশের পতাকা নিয়ে নিরাপদ না! হায় রে পতাকা!’
‎আমি সেই ধুলামাখা পতাকা স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।

হল ছেড়ে চলে যাওয়া ছাত্রদের সঙ্গে গণতন্ত্র তোরণের দিকে এগোতে থাকি। এসে দেখি ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, লালবাগ কলেজসহ আরও বিভিন্ন স্কুল-কলেজের অসংখ্য শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে তোরণের সামনে মিছিল দিচ্ছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পুলিশ কোনোভাবেই ভেতরে যেতে দিচ্ছিল না। একপর্যায়ে ছাত্ররা পেছনে এসে নীলক্ষেত রাস্তা অবরোধ করে দেয়। আমরাও যোগ দিই। স্লোগান চলতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ গণতন্ত্র তোরণের সামনে থেকে এগিয়ে এসে কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড মেরে আক্রমণ করতে থাকে। ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বেশির ভাগ ছাত্র আজিমপুর কবরস্থানের দিকে অবস্থান নেয়।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে হালকা অন্ধকার। নিউমার্কেট এলাকায় ছাত্রদের সঙ্গে ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা একত্র হতে থাকেন। আমরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করি। কিন্তু পুলিশের সাঁজোয়া যান ক্রমশ সামনে এগোতে থাকে। রাস্তার মাঝখানে ব্যারিকেড বসানোর চেষ্টা করি, যেন তাদের অগ্রযাত্রা রোধ করা যায়।

‎পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে করতে কবরস্থান পর্যন্ত চলে আসে, মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ইব্রাহিম ও আমি দ্রুত নিউমার্কেটের ভেতর দিয়ে পালানোর চেষ্টা করি। তখনই দেখি, মার্কেটের পেছনের রাস্তায় আওয়ামী লীগের একটি মিছিল কবরস্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে তারা সেখান থেকে কোন দিকে গেল, তা বুঝতে পারিনি।

‎আমরা মেইন রোড ধরে আবার নীলক্ষেতের দিকে যাই। ততক্ষণে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ফিরে যাচ্ছে। গণতন্ত্র তোরণের সামনে গিয়ে ভেতরের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুই পরিষ্কার হয় না। শরীর অবশ হয়ে আসছে, চরম ক্লান্তি গ্রাস করছে। কাঁদানে গ্যাসে শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে উঠেছে। অবশেষে ডিভাইডারের ওপর বসে পড়ি। নাকে-মুখে জ্বালাপোড়া করা গ্যাসের ধোঁয়া, চারপাশে যেন এক ঘন অস্থিরতা।

‎শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ