২০২৪ সালের জুলাই মাস, সারা বাংলাদেশ উত্তাল। ছাত্র–জনতার মিছিল, হাহাকার। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে রাজধানী ঢাকায় সংঘর্ষ, হামলা, গুলি, অগ্নিসংযোগসহ প্রাণহানি ঘটনা। দেশের অন্য জেলাগুলোর চিত্রও প্রায় একই রকম। দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা থামবেন না। থমথমে পুরো দেশ। ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ। যোগাযোগবিচ্ছিন্ন পুরো দেশ।
আমার দেশটাকে খুব অচেনা মনে হচ্ছিল, এ যেন এক ভয়ের বাংলাদেশ। মনে হচ্ছিল স্বাধীনতা নামক মুক্ত পাখিটাকে কেউ জোর করে বন্দী রাখতে চাইছে।
১৮ জুলাই ২০২৪
দেশের এই পরিস্থিতিতে মন বিষণ্ন, কত সুন্দর প্রাণগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এই হাহাকার কোথায় গিয়ে থামবে? আর কত প্রাণ ঝরলে সবকিছু ঠিক হবে? হঠাৎ নিউজফিডে চোখে পড়ল, একজন তরুণ ব্যাগভর্তি পানির বোতল নিয়ে বলছেন, ‘পানি লাগবে কারও, পানি?’ যখন জানলাম মীর মুগ্ধ বেঁচে নেই, একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পানি পান করাতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। এমন অসংখ্য মুগ্ধ সেদিন প্রাণ দিয়েছিল। অবচেতন মন বারবার বলছিল, ‘আমি কী করতে পারি?’ ঠিক তখন বান্ধবী লিমন মেসেজ দিল, ‘কাল ভৈরবে আন্দোলন, যাবি?’
মেসেজের রিপ্লাই সেন্ড করতে পারিনি, হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল ইন্টারনেট। মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই, অনেক চেষ্টার পর লিমনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা একসঙ্গে যাব। সারা রাত ঘুম হয়নি।
১৯ জুলাই ২০২৪
ভোরে উঠে সব কাজ সেরে সাড়ে নয়টায় বের হই ভৈরব বাসস্ট্যান্ডের দুর্জয় চত্বরের উদ্দেশে। ব্যস্ততম এই জায়গার দৃশ্যপট ভিন্ন, চত্বরের আশপাশে সুনসান নীরবতা, পুলিশে ঘেরা। আন্দোলনকারীরা আছেন চত্বর থেকে ৬০০ গজ দূরে ভৈরব থানার সামনে। লিমন আর আমি ছাড়া এই মুহূর্তে আশপাশে কেউ নেই। এ যেন ভয়ংকর ঝড়ের পূর্বের প্রকৃতির নীরবতা।
আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবনার সমাপ্তি ঘটাল একটা বিস্ফোরণের শব্দে। হঠাৎ চারদিক থেকে অনেকগুলো মানুষ এসে জড়ো হলো দুর্জয় চত্বরে। কিশোর বয়সী মেয়ের সংখ্যা বেশি। আমার দুই ছাত্রী সুমাইয়া আর সিবাও এসেছে।
‘প্লিজ মিস, আম্মুকে কিছু জানাবেন না, প্রাইভেটের কথা বলে এসেছি’। আমি কিছু বলার আগেই আবারও ধাওয়া, সবাই দৌড়ে এদিক–সেদিক চলে গেল। আমরা দৌড়ে রাস্তার পাশে এক বাড়িতে ঢুকি, কিন্তু এক মুরব্বির অকথ্য ব্যবহারে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি।
এই অনুভূতির সঙ্গে নতুন পরিচয়। অজানা আশঙ্কায় হাত-পা কাঁপা শুরু করল। মানুষ এত নির্মম!
‘আপনারা আমার সঙ্গে আসুন’—আমাদের বয়সী এক ছেলে ইশারা দিল, আমরা চারজন তাকে অনুসরণ করলাম। বাসার ছাদের এক নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখলাম রণক্ষেত্র। এত দিন যা বইয়ের পাতায় পড়েছি, সিনেমায় দেখেছি, তা আজ চোখের সামনে। কিছুক্ষণ পরপর গুলির শব্দ, মানুষের হইচই, ছোটাছুটি। মুহূর্তেই ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। স্বাধীন সূর্যের আলোকে যেন ধোঁয়া গ্রাস করে দিতে চাইছে। চোখে ভেসে উঠল ১৯৭১-এর আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি।
পরিস্থিতি আন্দোলনকারীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর পুলিশ চলে যায়। আমি আমার স্টুডেন্টদের রিকশা করে বাসায় পাঠালাম।
চত্বরে দাঁড়িয়ে মেয়েরা স্লোগান দিচ্ছে, ‘আমার ভাইবোনের রক্ত বৃথা যেতে দিব না, দিব না।’ অপরিচিত মুখগুলোকে খুব আপন মনে হচ্ছিল। বয়সে ছোট হলেও ওদের তেজস্বী কণ্ঠ আর সাহসী আচরণ অবাক করল। একজন এসে বলল, ‘আপু, আনাসের পিঠে ছিটাগুলি লেগেছে। হাসপাতালে ঢুকতে দিচ্ছে না, ফার্মেসির লোকের হাতে পায়ে ধরে কোনো রকম ব্যবস্থা করেছি।’ আনাস আমার ছোট ভাই। জানতাম না আনাস আন্দোলনে আছে।
২০ জুলাই ২০২৪
ভৈরবে প্রেস কনফারেন্স হয়। তখনকার সময়ের ক্ষমতাধর লোকেরা আন্দোলনের বিষয়টিকে টেনে ভৈরব বন্ধুসভার দিকে নিয়ে যান। ভৈরব বন্ধুসভার সভাপতি প্রিয়াংকা তাঁর নেতৃত্বে মেয়েদের নিয়ে গেছে। এ রকম কথা পুরো ভৈরবে ছড়িয়ে পড়ল। চত্বরে দাঁড়িয়ে পানি খাচ্ছি, এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ল স্থানীয় গ্রুপগুলোতে। পরনে সাদা-কালো ডোরাকাটা প্রিন্ট কামিজ।
ভৈরবের প্রতিটি মানুষের মতো আমিও স্বতন্ত্রভাবে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। আমার যা হবার হোক, বন্ধুসভা নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠবে? এমনকি এই বিষয়টির জন্য প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক এবং ভৈরব বন্ধুসভা উপদেষ্টা সুমন মোল্লা ভাইকেও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। সব মিলিয়ে ভয়ংকর একটা দিন।
২১ জুলাই ২০২৪
ভৈরবের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার আসামি হয়ে তালিকায় আমার নাম উঠল। মাটি সরে গেল পায়ের নিচ থেকে। সুমন ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলি, ‘আমার নামে মামলা হোক; কিন্তু আমার ভাই এবং বন্ধুসভার নাম যেন কোনোভাবেই না জড়ায়।’
তিনি অভয় দিয়ে বললেন, ‘তোমরা কোনো অন্যায় করোনি। সাধারণ নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতি চেতনা থেকে গিয়েছ, এটা তরুণদের দায়িত্ব।’
প্রথম দিন যতটা সাহস নিয়ে গিয়েছিলাম আন্দোলনে; সেদিন লোকলজ্জার ভয়ে ততটা গুটিয়ে ফেললাম নিজেকে।
সন্ধ্যার দিকে আনাসকে নিয়ে ভৈরব ছেড়ে নানুবাড়ি চলে যাই। রাতে আমাদের বাড়িতে পুলিশ এসে খোঁজখবর নিয়েছে। ভৈরবের আন্দোলনকারীদের অনেকেই পলাতক, কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়। দিন দিন আন্দোলনকারীদের দাবি শক্ত হচ্ছে আর দেশ অস্থির হচ্ছে।
এরই মধ্যে প্রায় ১৪ দিন কেটে গেল। এক সন্ধ্যায় নানুবাড়ির ছাদে বসে আন্দোলনের দিনের ভিডিওগুলো দেখছিলাম, আর ভয়ে ডিলিট করছিলাম। আমার একটা ছবিও ছিল। ছবিটা দেখে ভাবছি, হয়তো এই জামা আমার গায়ে আর কোনো দিন লাগানো যাবে না। বাইরে বের হলেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। ধরে নিয়ে গেলে পরিবার, সমাজ আমাকে কোন চোখে দেখবে? সমাজে আমার ঠাঁই হবে না। কারণ, সবার একই প্রশ্ন—মেয়েমানুষ হয়ে কি কেউ আন্দোলনে যায়? এত সাহস কোথায় পেলাম? বিব্রতকর ও বীভৎস ছিল সেইসব। অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
৫ আগস্ট ২০২৪
বিকেলে লিমনের ফোন, ‘প্রিয়াংকা, আমরা হারি নাই। আমাদের চাওয়া, দেশের মানুষের চাওয়া পূরণ হলো। আমরা পেরেছি।’
বদলে গেল পুরো দৃশ্যপট। আমাকে মামলার আসামি করে যারা বলেছিল, এই মেয়েকে মামলার আসামি দিতেই হবে। আজ তারাই আসামি হয়ে পলাতক অবস্থায়। স্বৈরাচারীর পতন হয় তার কর্মফলে। ইতিহাস বলে, এ দেশে যতবার বিপ্লব এসেছে, সাধারণ ছাত্রদের হাত ধরে এসেছে।
লিমনের সঙ্গে কথা হওয়ার পর বুকভরে নিশ্বাস নিলাম। নতুন স্বাধীনতার সূর্য যেন অস্তমিত না হয়। আমার শহর, দেশ হোক সুন্দর, শান্তিপূর্ণ।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা