২০ দিনের বন্দিজীবন ও ফিরে আসার গল্প

২০২৪ সালের জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কার দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে সেটি একসময় দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। গাজীপুরেও এর আঁচ লাগে। আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকার কারণে ১৮ জুলাই গ্রেপ্তার হন গাজীপুর বন্ধুসভার সহসভাপতি জহিরুল ইসলাম। ২০ দিন কাটিয়েছেন ডিবি হেফাজতে, থানা ও কারাগারে। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও ভাঙচুরের অভিযোগ আনা হয়। পরে সরকার পতনের পর ৬ আগস্ট জামিনে মুক্ত হয়ে ছাড়া পান। সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তিনি।

জহিরুল ইসলামছবি: সংগৃহীত

জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়। আন্দোলন তখন আর কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ শিক্ষার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন। আমারও ইচ্ছা করছিল, কিন্তু গাজীপুরের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করায় সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। তবে ‘গাজীপুর হেল্পলাইন’ নামে একটি ফেসবুক পেজের অ্যাডমিন ছিলাম।

১৭ তারিখ জয়দেবপুরে এক আন্দোলনের লাইভ করেছিলাম। আমার গ্রুপে আন্দোলনকেন্দ্রিক সব পোস্ট অ্যাপ্রুভ করতাম। পোস্টগুলো অনেক রিচ পায়। ১৮ জুলাই বিকেলে সাদাপোশাকে ডিবি পুলিশের ১০ জন সদস্য আমার দোকানে আসেন। তাঁরা বলেন, ‘আমার সঙ্গে বড় স্যার কথা বলবেন। এই বলে আমাকে গাজীপুর ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে টালবাহানায় ফেলে রাখা হয়। বলেন বড় স্যার ব্যস্ত, বাইরে গেছেন। এরপর রাত ১১টায় আমাকে লকাপে রাখেন।’

১৯ তারিখ ছিল শুক্রবার। সারা দেশের মতো গাজীপুরেও আন্দোলন ও হামলা হয়। তখন বাইরের কারও সঙ্গেই আমাকে যোগাযোগ করতে দেয়নি, পরিবারের সঙ্গেও না। আমার কাছে পেজ ও গ্রুপের তথ্য চাওয়া হয়, সব পোস্ট ডিলিট করিয়ে নেয়, বাকি অ্যাডমিনদের নামও চায়। কেউ কেউ গালিগালাজ করছিল। জানায়, সরকারের পক্ষে পোস্ট দিলে আমাকে ছেড়ে দেবে। রাজি হলেও আর কথা হয়নি। ২০ তারিখ বিকেলে আমাকে গাজীপুর সদর থানায় পাঠিয়ে দেয়।

ডিবি অফিসে তিন দিন ছিলাম। সঙ্গে আরও চারজন ছিল, অন্য মামলার আসামিরাও ছিল। এক দিন সদর থানায় রেখে তারপর কারাগারে পাঠায়। ১৯ তারিখে গাজীপুরে যে ভাঙচুর ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়, সেখানে আমাকে আসামি করে তারা। অথচ ১৮ তারিখ থেকে আমি ডিবির হেফাজতে।

রাতের বেলা আমাদের কোর্টে নেওয়া হয়। গাদাগাদি করে প্রিজন ভ্যানে। খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। তখন ডিবি অফিসেই এক এসআইয়ের মাধ্যমে এক ভাইকে জানিয়েছিলাম, যেন আমার পরিবারে কথাটি জানায়।

৬ আগস্ট ২০২৪, কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর
ছবি: সংগৃহীত

কারাগারের অভিজ্ঞতা খুবই ভয়ংকর। এক রুমে ১৭০ জন। খাবার বলতে দুপুরে ভাতমাখা, খিচুড়ির মতো কিছু; যা কেউ খেতে পারছিল না। বিছানা, বালিশ কিছুই ছিল না। ঘুমানো অসম্ভব। ২৪ ঘণ্টা লাইট জ্বলে। ৪ দিন গোসল ছাড়া, ঘুম ছাড়া কেটেছে। এই সময়ে বন্ধুসভাসহ বিভিন্ন সংগঠনের ভাইয়েরা আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানসিক ও আর্থিক সহায়তা করেছেন।

আমার মেয়ের বয়স তখন ৩ বছর ১০ মাস। ও আমাকে ছাড়া এক দিনও কখনো ছিল না। সারা দিন কাঁদত। মা বিছানায় পড়ে গিয়েছিল। কারাগার থেকে একটা চিরকুট দিয়ে বাসায় জানাই যেন মেয়েকে বোঝায় আমি ঢাকায় আছি। মেয়েকে না দেখতে পারার যন্ত্রণা ছিল সবচেয়ে বেশি। পরে পরিবার থেকে যোগাযোগ করায় ৭ দিনের রিমান্ড ৩ দিনে শেষ হয়। তেমন শারীরিক টর্চার হয়নি, তবে ভয় দেখিয়ে পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

কারাগারে সময় খুব ধীরে কাটত। খাওয়া যায় না এমন রুটি দিত—তাতে বালু লেগে থাকত। একদিন রুটি ধুয়ে খেয়েছি। বাসার খাবার নেওয়ার অনুমতি ছিল না, তবে টাকা দিয়েছিল।

মনে হয়েছিল ৬ মাসের আগে ছাড়া পাব না। আশপাশের সবাইও একই কথা বলত। মেরে ফেলার হুমকিও আসত। নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত রাখতাম।

কারাগারে প্রতিদিন পত্রিকা পড়া হতো। দেশের অবস্থা দেখে ভয় পেতাম। সরকার পতনের দিন ৫ আগস্ট বিটিভিতে সেনাপ্রধানের ভাষণের ঘোষণা এলে বুঝি কিছু একটা হচ্ছে। এরপর বিকেলে কল দিয়ে বাসায় কথা বলি। জামিনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৬ আগস্ট রাতে জামিনে মুক্তি পাই। জেলগেটে ৩০-৪০ জন বন্ধু, সংগঠনের ভাইয়েরা অপেক্ষা করছিলেন। বাসায় ফিরে দুধ দিয়ে গোসল করায়। মেয়েকে কোলে নিই।

অফিসে, বাসায় পরিবেশ স্বাভাবিক ছিল। ফলে সহজেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। তবে স্মৃতিগুলো ভুলতে পারিনি। কিছু ভালো মানুষের কথা মনে পড়ে, তারা জেলেও মানবিক ছিল। পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল তাদের দলে যোগ দেওয়ার জন্য। তবে আমি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করিনি, কোনো স্বীকৃতিও নিইনি।

বন্ধু, গাজীপুর বন্ধুসভা