আজ খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশে। চারদিকে জ্যোৎস্না বিলাচ্ছে। লেকের পাশে প্রেমিক যুগলেরা জ্যোৎস্না উপভোগ করছে। কিছুক্ষণ পরপর একরাশ ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে, গাছের পাতার ধ্বনিতে অপার্থিব আনন্দের সুর তৈরি হচ্ছে। চাঁদের আলোয় লেকের পানির ঢেউ চিকচিক করছে। প্রকৃতির চারদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ। অপেক্ষা সব সময় বিরক্ত নিয়ে এলেও কিছু অপেক্ষা হয় বেশ মধুর। আজ তাশহানের মধুর অপেক্ষার প্রহর যেন কাটছেই না।
কিছুদিন আগেও অন্য রকম এক জীবন ছিল তাশহানের। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে বড় হয়েছে মামার কাছে। কলেজে পড়ার সময় যখন মামা মারা যান, তখন সেই আশ্রয়স্থলটুকুকেও বিদায় জানাতে হয়। ধীরে ধীরে একসময় শহুরে জীবনের অন্যায় জগতের সঙ্গে মিশে যায়। আজ সবকিছু বিদায় জানানোর দিন। বিন্তা পাশে এসে বসার পর সংবিৎ ফিরে পায় তাশহান:
: কখন এলে?
: কিছুক্ষণ হলো।
: সাদা রঙে বেশ মানিয়েছে তোমাকে। একেবারে জ্যোৎস্নারূপসী।
: আপনি তো বেশ সাহিত্যিকভাবে কথা বলেন।
স্মিত হেসে বিন্তার হাত ধরে তাশহান বলে, ‘সব তোমার অবদান’
: কি সুন্দর জোছনা তাই না? একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বিন্তার দিকে তাকায় তাশহান।
: আমাদের যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল, সেদিন জ্যোৎস্না ছিল। এরপর থেকে যতবার আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে, সঙ্গী থাকে চাঁদের মায়াবী আলো।
: চাঁদের এই মায়াবী আলো/ লাগছে তোমায় বেশ ভালো
খিলখিল করে হেসে ওঠে বিন্তা। হাসিটা প্রতিধ্বনি হয় লেকের বহমান পানিতে, ঝিরঝির পাতার ফাঁকে, চাঁদের আলোর মায়াতে। বিন্তার কোমল কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে:
‘চাঁদনি পসরে কে আমারে স্মরণ করে,
কে আইসা দাঁড়াইছে গো আমার দুয়ারে।
তাহারে চিনি না আমি,
সে আমারে চেনে।’
গানটা হঠাৎ থেমে যায়। তাশহান তাকিয়ে দেখে বিন্তার চোখে পানি। সে তাশহানের কাঁধে মাথা রেখে বলে:
: জানেন, গানটি আমার খুব প্রিয়। ছোটবেলায় আকাশে যখন চাঁদ একা প্রতিনিধিত্ব করত, তখন মা শোনাত। তাই তো এই চাঁদ, জ্যোৎস্না, আকাশ—আমার এত আপন। আর এখন সেই তালিকায় যুক্ত হলেন আপনি।
কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে বিন্তার চোখ থেকে। এই অশ্রুজল কষ্টের নয়, আনন্দের।
সমুদ্র আর মানুষের মধ্যে এক জায়গায় বেশ মিল রয়েছে। সমুদের নোনা জল আর মানুষের নোনা অশ্রুজল। আমাদের দুঃখগুলো গড়িয়ে পড়ে সমুদ্রে মিশে যায়। তাই তো এত গর্জন, এত ঢেউ সমুদ্রের বুকজুড়ে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে একবার হলেও সমুদ্রের কাছে যাওয়া উচিত।
রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে তাশহানের মোটরসাইকেল চলছে। বিন্তা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে:
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘সমুদ্রের কাছে,’ তাশহান জবাব দেয়।
: শুরু থেকে আমার সব ইচ্ছা আপনি পূরণ করেছেন। এবার সমুদ্র দেখার ইচ্ছাটাও পূরণ হবে। আজ আমি অনেক খুশি।
বিন্তা, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই...
কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই পকেটে থাকা মুঠোফোন বেজে ওঠে। একটা টংদোকানের সামনে মোটরসাইকেল রেখে কল রিসিভ করে সে। সলিমের কল।
: বস, কেমন আছেন? সব ঠিকঠাক আছে তো?
: হ্যাঁ, এই অসময়ে ফোন করলি কেন?
: আপনার জন্য টেনশন হচ্ছিল, এখন কোথায় আছেন?
: কাচপুর ব্রিজের কাছাকাছি, চট্টগ্রাম যাচ্ছি।
সজোরে একটা থাপ্পড় বসে সলিমের মাথায়। কলটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ক্রূরভাবে হেসে ওঠে আরাফ। তাশহান কলব্যাক করে; কিন্তু সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। অজানা এক আশঙ্কা তার মনকে ভাবিয়ে তোলে।
: এই যে তাশহান সাহেব এখানে আসুন, একসঙ্গে চা পান করি। বিন্তার ডাকে সংবিৎ ফিরে পায় সে।
: জানেন, আপনার সঙ্গে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কাটাচ্ছি। আজ অনেক খুশি। মাঝেমধ্যে ভয় হয়, এত সুখ স্থায়ী হবে তো!
তাশহান ওর হাত ধরে বলে:
‘যত দিন বেঁচে আছি, কষ্ট তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না’
আবার মোটরসাইকেল চলতে শুরু করল। আকাশে এখন জ্যোৎস্না নেই, মেঘেরা আড়াল করে রেখেছে। চারদিকে গুমোট বাঁধা অন্ধকার। নিস্তব্ধতা চারদিকে। রাস্তা বেশ ফাঁকা, কাঁচপুর ব্রিজে কোনো গাড়ি নেই, তাশহান গতি বাড়িয়ে দিল। বিন্তা পিঠে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ একটি ট্রাক সামনে থেকে সজোরে ধাক্কা দিল। কয়েক ফুট শব্দহীন শূন্যে ভেসে ছিটকে পড়ল তাশহান। বিন্তা ল্যাম্পপোস্টে বাড়ি খেয়ে সশব্দে আছড়ে পড়ল। শেষ মুহূর্তে আরাফের পৈশাচিক হাসিটা কানে এল; আর এল গুলির শব্দ, তারপর জ্ঞান হারাল বিন্তা।
দুই বছর পর…
আমাদের বিন্তা কি আর আগের মতো হবে না ডাক্তার? হতাশামিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল তার বাবা। মনোচিকিৎসক কবির আহমেদ বললেন, ‘বিন্তা একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছে। বিগত সময়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে ওর, নাম ধরে ডাকলে মাঝেমধ্যে সাড়া দেয়। কয়েক দিন ধরে লক্ষ করছি, চাঁদ দেখলে অস্থিরতা কাজ করে ওর মধ্যে। কিছুদিনের মধ্যে আমরা নতুন একটি চিকিৎসায় যাব।’
আজ সেদিনের মতোই চাঁদ উঠেছে আকাশে। জ্যোৎস্নার আলো জানালায় পড়ছে। বিন্তা বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে যায়। চাঁদের আলো পড়ছে তার মুখে। শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিন্তা বলে, ‘আজ তাশহান আসবে।’
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা