অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও চিৎকার করতে পারছে না বিন্তা। হাত-পা-মুখ শক্ত করে বাঁধা, ধস্তাধস্তি করতে করতে একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে সে। ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটা ঘরে আবিষ্কার করে, রুমের চারপাশে নজর বোলাতে থাকে বিন্তা। সিনেমায় সে দেখেছিল যে কিডন্যাপারদের আস্তানা খুব নোংরা হয়। কিন্ত এখানে বাচ্চাদের ঘরের মতো রুমে অনেক খেলনা, বিভিন্ন রঙের ফুল আর সবকিছু পরিপাটি করে সাজানো। বিন্তাকে একটা চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে। সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু পারল না। মুখ বাঁধা। এমন সময় রুমে একদল লোক প্রবেশ করে।
লোক ১: এই মাইয়া, এত ছটফট করস ক্যান? চুপ কইরা বইয়া থাক।
ধমক দেওয়ায় বিন্তা কেঁদে ফেলে।
লোক ২: হা হা দেখ বল্টু, ছিঁচকান্দুইন্না মাইয়া। হা হা হা!
লোক ৩: এই তোরা থাম, বস আইতাছে।
চোখে গ্লাস, মুখভর্তি দাড়ি, হাতে পিস্তল নিয়ে বস রুমে ঢোকে। সিনেমায় হলে স্লোমোশনে এন্ট্রি দেখানো হতো, প্রবেশপথের দিকে তাকিয়ে আপনমনে ভাবতে থাকে বিন্তা। একজন চেয়ার এগিয়ে দেয়, বস তাতে বসে পড়ে।
বস: এখনো বেঁধে রেখেছিস?
: বস, মাইয়া বহুত নড়াচড়া করে।
: এই ওর মুখ খুলে দে।
একজন এগিয়ে এসে বিন্তার মুখের বাঁধন খুলে দেয়।
‘আমাকে ধরে এনেছেন কেন? কী ক্ষতি করেছি আপনাদের?’ চিৎকার করে বলতে থাকে বিন্তা।
: চিৎকার করে লাভ নাই। এখানে কেউ তোমাকে উদ্ধার করতে আসবে না।
গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয় বস।
: আমি বাসায় যাব। এখানে থাকব না।
: চুপ! একদম চুপ, আর একবার চিৎকার করলে থাপ্পড় মেরে...।
ধমক শুনে আবারও কেঁদে দেয় বিন্তা।
: এই মেয়ে, কান্না থামাও বলছি; কান্না আমি সহ্য করতে পারি না।
: আমাকে কেউ আগে এভাবে কখনো বকেনি।
: কান্না থামাবে, নাকি গুলি করব? (বিন্তার দিকে পিস্তল তাক করে)
: আইসক্রিম খাব।
: কী?
: আইসক্রিম খাওয়ান, তাহলে আর কাঁদব না।
: ঝামেলা! এই, ওকে আইসক্রিম এনে দে।
: এই নাও, খাও।
: হাত না খুলে দিলে খাব কী করে?
: বোকা মনে করো আমাকে? হাত খুলে দিই, আর তুমি পালিয়ে যাও?
: এভাবে আইসক্রিম খাওয়ালে কখনো যাব না।
পাশের একজন কানে কানে বলল, ‘বস আমার মনে হয়, এই মেয়ে চরম বোকা, নয়তো চালাক।’
: হুম, এই নাও খাও।
বস নিজের হাতেই আইসক্রিম খাইয়ে দিচ্ছে বিন্তাকে। এদিকে বিন্তা ছোট বাচ্চার মতো আপনমনে খেয়ে চলেছে। অনেকক্ষণ পর আবার চিৎকার করে উঠে বিন্তা।
: এই আবার কী হলো?
: আপনি বারবার আমাকে এই মেয়ে বলেন কেন? আমার একটা সুন্দর নাম আছে। আমার নাম বিন্তা।
: হুম, তা আবার চিৎকার করছ কেন?
: গোসল করব।
: হবে না। চুপ করে বসে থাকো।
: না না না, গোসল করব।
: কী মুশকিল উঠিয়ে আনলাম। শোনো, আরাফের জায়গায় অন্য কারও জন্য হলে এতক্ষণে তোমাকে শেষ করে দিতাম। (ধমক শুনে আবার কেঁদে দেয় বিন্তা)
: আবার কান্না? এই সলিম, হাবুল, কই তোরা? মহারানির গোসলের ব্যবস্থা কর।
মুখে হাত দিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় বিন্তা। আপনমনে কেঁদে চলেছে। ওদিকে বস ভাবছে, একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললাম না তো?
: এই যে শোনো, কান্না থামাও। (বিন্তা কেঁদেই চলেছে), তোমাকে ফুচকা খাওয়াব।
বিন্তা গোসল করছে আর ভাবছে আরাফের কথা। আরাফ ওর সহপাঠী। বড়লোক বাবার বখাটে ছেলে। বিন্তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। অনেক দিন ধরে অনেকভাবে বিন্তাকে প্রস্তাব দিয়ে আসছে। কিন্তু বিন্তা রাজি হয়নি। এমন বখাটে ছেলের জন্য কি কোনো ভালো মেয়ে রাজি হবে?
: এই যে বাইরে কেউ আছেন?
: জি আফা কন?
: আমার ড্রেস লাগবে।
: আইচ্ছা বসরে কইতেছি।
: কী ব্যাপার, এখন আবার ড্রেস কেন?
: গায়ের কাপড় ময়লা হয়ে গিয়েছিল, ধুয়ে দিয়েছি।
: ঠিক আছে ড্রেস আনার ব্যবস্থা করছি।
: বাজিরাও মাস্তানি লাগবে।
: বাজিরাও কী?
: বাজিরাও মাস্তানি, পোশাকের নাম।
: এসব হবে না। জামা দিচ্ছি, পরে নাও।
: না না, আমার ওটাই চাই, এবারের ঈদে ওটাই পরতাম। ধরে এনে তো ঈদটা মাটি করে দিলেন। ওটা না দিলে কেঁদে দেব কিন্তু!
: ওকে ম্যাম, ওকে!
অবশেষে কাঙ্ক্ষিত পোশাক পরে বের হয় বিন্তা। বস অবাক চোখে দেখছে আর ভাবছে, এত মায়াময় চেহারা কেন মেয়েটার?
: আমি এসব খাব না।
: বিরিয়ানি তো মজার জিনিস, খেয়ে নাও।
: আমি এখন ফুচকা খাব।
: এই রাতে ফুচকা কোথায় পাব?
: ওই যে তিন নম্বর রোডে রাত ১২টা পর্যন্ত ফুচকা বিক্রি করে।
: এখন এসব আনা সম্ভব নয়।
: না, আমি ফুচকাই খাব।
: চুপ।
মুখে হাত দিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় বিন্তা। আপনমনে কেঁদে চলেছে। ওদিকে বস ভাবছে, একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললাম না তো?
: এই যে শোনো, কান্না থামাও। (বিন্তা কেঁদেই চলেছে), তোমাকে ফুচকা খাওয়াব।
: সত্যি?
: হুম।
: আমিও যাব আপনার সঙ্গে?
: কেন?
: আপনি অনেক ভালো। আপনার সঙ্গে ঘুরব।
: না, হবে না, এখানেই থাকো।
: না, থাকব না, আমি যাব।
ফুচকা খাওয়ার পর বিন্তা জেদ ধরল, সে বাইকে করে ঘুরবে।
এই মুহূর্তে তারা বাইকে করে ঘুরছে।
: আচ্ছা আপনার ভালো নাম কী?
: তাশহান।
: সুন্দর নাম। তাহলে ওরা আপনাকে বস বলে ডাকে কেন?
: কারণ, আমি ওদের বস।
: কিন্তু আপনাকে একটুও ওদের বস মনে হয় না। সিনেমার হিরো মনে হয়।
: তুমি কি পিকনিকে যাচ্ছ?
: না তো, কেন?
: এত কথা বলছ কেন?
: আমার কথা বলতে ভালো লাগে, কথা না বলে থাকতে পারি না। এই এই বাইক থামান, স্টপ স্টপ।
: কী হলো আবার? (বাইক থামিয়ে জিজ্ঞেস করে তাশহান)
: দেখুন, পানিতে কত সুন্দর জ্যোৎস্না পড়েছে। চলুন ভিজি।
: জোছনায় ভেজা যায়?
: হুম, মন থেকে চাইলে যায়। আমি যাচ্ছি জ্যোৎস্নাস্নান করতে, আপনিও আসুন।
বাচ্চারা পছন্দের জিনিস পেলে যেভাবে লাফিয়ে ওঠে, সেভাবে লাফাচ্ছে বিন্তা। ‘মেয়েটা আসলেই অন্য রকম, এত বড় হয়েছে; মনটা এখনো বাচ্চার মতো।’ এসব ভাবছে তাশহান, তখনই কল আসে। কল করেছে আরাফ।
আরাফ: কী অবস্থা দোস্ত? কাজ হয়েছে?
তাশহান: হয়েছে।
: আমাকে জানাসনি কেন? তোকে না বলেছিলাম, কাজ হওয়ার পর ফোন করতে।
: তুই কি এক পাগলিকে ওঠাতে বললি? কিডন্যাপ করার পর থেকে ওর আবদার মেটাতে মেটাতে আমি শেষ।
: বিন্তা একটু এমনই। তুই এই রাতটা পর্যন্ত সহ্য কর, সকালে ওর একটা ব্যবস্থা করব।
: কী করবি?
: অনেক ঘুরিয়েছে আমায়। ওর আসল জায়গা দেখিয়ে দেব! হা হা হা....!
পৈশাচিকভাবে হেসে ওঠে আরাফ। ঘটনা আঁচ করতে পেরে তাশহান এগিয়ে যায় বিন্তার দিকে।
: আপনি এসেছেন? দেখুন কত সুন্দর জোছনা।
: তুমি আরাফকে ভালোবাসো?
: নাহ, ওর মতো বখাটেকে দেখতে পারি না, ভালোবাসা তো দূরে থাক।
: আমাকে বলা হয়েছিল যে তুমি আরাফকে ভালোবাসো, বাসা থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে তোমার। তোমাদের দুজনকে এক করার জন্য তোমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।
: কিডন্যাপ করে ভালো করেছেন। বাসায় আমাকে বন্দীর মতো থাকতে হয়। নিজের ইচ্ছেমতো কিছুই করতে পারি না। কিন্তু আজ অনেক স্বাধীন লাগছে। মনে হচ্ছে, সত্যিই আমি আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক।
: আরাফের আসল উদ্দেশ্য এখন জানতে পারলাম। আগে জানলে তোমাকে কিডন্যাপ করতাম না। তুমি পালিয়ে যাও।
: মানে কী? এত রাতে কোথায় যাব?
: বাসায় যাবে।
: না, আমি কোথাও যাব না, আপনার সঙ্গেই থাকব।
: শোনো বিন্তা, অনেক পাগলামি করেছ, আর না।
: ওয়াও, আপনি আমার নাম ধরে ডাকলেন!
: চলো, তোমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিচ্ছি।
: না, আমি যাব না। আপনার সঙ্গেই থাকব।
পেছনের পকেট থেকে রুমাল বের করে বিন্তার মুখে চেপে ধরে তাশহান। অজ্ঞান বিন্তাকে তার বাসায় রেখে আসে সে।
চলবে .....
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা