বাপন

ছবি: এআই/বন্ধুসভা
বাপন আরও কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর বসা থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেল। মাথার মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল।

দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ হলে মেঝেতে রাখা থালাতেই হাত ধুয়ে বসে রইল বাপন। তাকে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে পাশে বসা সুজিত সাহেব বললেন, ‘খাওয়া তো শেষ, এখন উঠে যা, বসে আছিস যে, দোকানে যাবি না?’ বাপন বলল, ‘যাব। তবে আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল।’
—তা কী বলবি, বল। কিছু লাগবে তোর? টাকা বা অন্য কিছু? তোর জন্য একটা নতুন পাঞ্জাবি এনেছিলাম। তোর দিদি তোকে দিয়েছিল? দাঁড়া, ইশার মাকে এখনো ডাক দিচ্ছি। কী গো শুনছ?
—দাদা, দিদি আমাকে পাঞ্জাবিটা দিয়েছে। আমি অন্য বিষয়ে কথা বলব।
—তা, কী বলবি বল তাড়াতাড়ি, আমাকে এখন ওই বাড়িতে একটু যেতে হবে। জানিস তো, সীমানার ইটের দেয়ালটা ভেঙে গেছে, নতুন করে দিতে হবে।
—জানি দাদা।
—তাহলে দেরি না করে কী বলবি দ্রুত বল।
—সামনের সপ্তাহে কাতারে যাওয়ার ফ্লাইট। আমি চাই আপনি আর দিদি যদি...।

কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সুজিত সাহেব হাত ইশারা করে বাপনকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আগামী দুই দিন আমার অনেক কাজ আছে। তুই যখন ঠিক করেই নিয়েছিস যে চলে যাবি, তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই। তোর দিদির কাছ থেকে টাকা নিয়ে জামাকাপড়সহ আর কী কী লাগে, কিনে নিয়ে যাস। আমার আর্শীবাদ সব সময় তোর সঙ্গে থাকবে।’ বলেই উঠে চলে গেলেন সুজিত সাহেব।

বাপন আরও কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর বসা থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেল। মাথার মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। নিজের মনের কথাগুলো কীভাবে প্রকাশ করবে, এসব চিন্তা করতে করতে সে টেবিলে বসে খাতায় চিঠি লিখতে শুরু করল।

প্রিয় দাদা,
আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনার অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদেশযাত্রা করতে যাচ্ছি। জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রবাসী হওয়া আমার জন্য নতুন কিছু নয়, তা আপনি ভালো করেই জানেন। তবু বলছি, ছোট্টবেলা থেকেই আমার এ বাড়ি–ও বাড়ি করে জীবন কেটেছে। মা যখন মারা যায়, তখন আমার বয়স হবে দুই কি আড়াই বছর। মায়ের চেহারাটাও ভালো করে মনে নেই। ছবি দেখে এখন মনে রাখি। তারপর নিজ বাড়ি থেকে আমাকে নিয়ে আসে মায়ের আপন বোন পারু মাসি। সেখানে কাটল কয়েক বছর। মাসির বাড়ির সবার সঙ্গে আমার যে ঠিক কোন জায়গায় পার্থক্য, সেটা বুঝতে সময় লাগল। বয়স বাড়তে বাড়তে বুঝলাম, তিনি আমার মা নন, মাসি। দারিদ্র্যে ভরা মাসির সংসারে দুবেলা ভাতও ঠিকমতো খেতে পারতাম না। ঘুমানোর সময় সবার স্থান চৌকিতে হলেও আমার হতো নিচে মাটিতে কাঁথা বিছিয়ে। তাই আজও সব সময় মেঝেতে বিছানা করে ঘুমাই। ওটাই আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।

আপনি আমার আত্মীয়স্বজনদের কেউ না হয়েও শুধু শ্বশুরবাড়ির প্রতিবেশীর এক আশ্রিত ছেলের কষ্ট দেখে যে তার দায়িত্ব সেদিন নিয়েছিলেন, তার জন্য সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। দারিদ্র্য আর কষ্টে ভরা পরিবেশ থেকে আপনি আপনার বাসায় আমাকে জায়গা দিয়েছিলেন। পড়াশোনা করিয়েছেন, আপনার কল্যাণে প্রাইমারি পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছিল। তাই এখন লিখতে ও পড়তে পারি। ফাইভ পাস করিয়ে আপনি আমাকে দোকানে বসালেন। আমার সব দায়িত্ব নেওয়ার পরও আপনি মাসিক একটা নির্দিষ্ট টাকা আমার পালক মাসিকে নিয়মিত পাঠাতেন। সে টাকা জমিয়ে মাসি ওনার কাছে রেখে ওনার বাড়িটা নিজের অবাধ্য সন্তানদের না দিয়ে আমার নামে লিখে দিয়েছেন। বাড়ির জায়গাটা নিয়ে যদিও শুনেছি গন্ডগোল আছে, মামলা চলছে; তবু মাসি তো, মায়ের মৃত্যুর পর তিনিই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাই ওনার সিদ্ধান্তের ওপর আর কথা বলিনি। আর বাবাকে কখনো দেখিনি, মাসিও এ নিয়ে কখনো কিছু বলেননি। কয়েক মাস আগে অবশ্য একজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানাল যে বাবা গত হয়েছেন কয়েক বছর হলো, আমি যেন তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখি। আমি কিছু না বলেই সেদিন কলটা কেটে দিয়েছিলাম।

এখন আমার বয়স ২১। দীর্ঘ কয়েক বছর জোর করেও ভাত খাওয়াতে না পারা এই আমি তিন বছর ধরে ভাত খাচ্ছি। এখনো ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। আপনি, দিদি আর এই বাড়ির কত লোক কতভাবে চেষ্টা করতেন আমাকে ভাত খাওয়ানোর জন্য, কিন্তু ব্যর্থ হতেন সবাই। ছোট্টবেলায় যে মাসির বাড়িতে থেকে ভাতের কষ্টে ভাত খাওয়া ছেড়েছিলাম, সে মাসি যেদিন অনেক অনুরোধ, কান্নাকাটি আর অনুশোচনা করে আমার মুখে ভাত তুলে দিলেন, সেদিন থেকে আজও আমি একবেলা করে ভাত খাচ্ছি।

আপনার কোনো ছেলেসন্তান নেই। আপনি বলেছিলেন, আপনার অবর্তমানে ব্যবসার হাল আমাকেই ধরতে হবে। আপনার করা দুটি বাড়ি থেকে একটি আমার নামে লিখে দেবেন, মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে সংসারী করাবেন আমাকে।

আমি আপনার কোনো কথা না শুনেই বিদেশে চলে যাচ্ছি, অল্প সময়ে বেশি অর্থ উপার্জনের আশায়। আমার কাছে এই মুহূর্তে এটাই ঠিক মনে হয়েছে। যদি সেখানেও ব্যর্থ হই, তাহলে আবার আপনার কাছে ফিরে আসব। আপনি কথা দিয়েছেন, সেদিনও আমায় ফিরিয়ে দেবেন না। আমি সে আশা নিয়েই যাচ্ছি। শুধু শেষ অনুরোধ, যাওয়ার সময় এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আপনি ও দিদি আমার সঙ্গে যাবেন বিদায় জানাতে। মা-বাবা বেঁচে থাকলে তাঁরা অবশ্যই যেতেন। আপনারা আমার মা-বাবার সমতুল্য। আপনাদের আশীর্বাদ নিয়েই প্রবাসজীবনে যেতে চাই। ভালো থাকবেন, পারলে এই অধমকে ক্ষমা করবেন।

ইতি
আপনার স্নেহের ভাই
বাপন

লেখা শেষে ভাঁজ করে চিঠিটা খামে ভরল বাপন। সকালেই খামটা সে কিনে এনেছিল। আজকাল কেউ চিঠি লেখে না, তা সে জানে। তবু মনে হলো, এটাই একমাত্র উপায় মনের জমানো কথাগুলো খুলে বলার। চিঠি নিয়ে রুম থেকে বের হতেই ভাগনি ইশার সঙ্গে দেখা। বাপন তাকে ডাক দিল, ‘ইশা শোন, এই চিঠিটা তোর বাবাকে দিবি, বলবি আমি দিয়েছি।’ ইশা প্রথমে অবাক হলো, দুচোখ বড় বড় করে কৌতূহলের সঙ্গে তাকিয়ে বলল, ‘আজকাল কেউ চিঠি লেখে? আবার তুমি চিঠি লিখলে বাবাকে! আজব ব্যাপার! দোকান-বাড়ি মিলে সারা দিন কতবারই তো দেখা হয়, তখন কত কথা বলো। আবার চিঠি কেন?’
—তুই বুঝবি না। তোকে যা বললাম, শুধু তুই তা করিস।
—আচ্ছা ঠিক আছে। মামা শোনো, মা বলেছে বের হওয়ার আগে মায়ের সঙ্গে দেখা করে যেতে, কী কী যেন আনতে হবে। আজ সন্ধ্যায় বড়দি-দাদাবাবুরা আসবে। আর হ্যাঁ, বাবার গায়ের চাদরটা রেখে গেছে, ওটা নিয়ে যেয়ো। ওই যে টেবিলের ওপর রাখা।
—আচ্ছা ঠিক আছে, দিদির সঙ্গে দেখা করছি গিয়ে।

এ কথা বলে বাপন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। ভাবছে, এত দিনের বন্ধন ছেড়ে কীভাবে এত দূরে চলে যাবে। আপন বলতে এখন সে তাদেরই বোঝে। ভুল না ঠিক করছে, এখন আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নেই।

নিজের জমানো কিছু অর্থ আর ঋণ করা অর্থ নিয়ে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাপন। তাই এখন আর পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। বাপন শুধু ভাবছে, আদৌ চিঠিটা দাদা পড়বে তো!

হাজীপুর, নরসিংদী