রাত তখন প্রায় মাঝপথে। শহর পেছনে ফেলে এসেছি। কোলাহল থেমেছে। ধোঁয়ার স্তব্ধতা যেন জমে আছে ফুসফুসে। সিগন্যালের তীব্র শব্দ এখন কেবল স্মৃতি। আলোকবিজ্ঞাপনের কৃত্রিম ঝলকানি নেই চোখে। এখন আমি গ্রামে। অনেক বছর পর ঘরে ফিরেছি। মায়ের উঠানে, স্মৃতির ভেতর। পায়ে পায়ে পৌঁছালাম উঠানে। মাথার ওপর আধভাঙা চাঁদ, পুকুরপাড়ের তালগাছের ছায়া, আর গা ছমছম করা জোনাকির ঝিলিক।
ঘরের দরজা খোলা। মা নেই, তবু ঘরে মায়ের গন্ধ ঠিকই আছে। যেন এখনো সকালবেলা উঠেই হাঁসি মুখে ডেকে বলবে, ‘খোকা, ঘুম ভাঙছে না?’ বালিশের পাশে রাখা সেই পুরোনো কাঁথা, যার একেকটা সেলাইয়ে মিশে আছে একেকটা গল্প, একেকটা শীতের রাতের ওম, একেকটা অসুখে জেগে থাকা রাতের প্রার্থনা।
কাঁথাটা হাতে নিই। এ কাঁথা আর কাঁথা নয়, এ যেন ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’-এর বিহ্বল কোনা থেকে উঠে আসা শাড়ির আঁচল। মা যে সেলাই করতেন নিঃশব্দে, যেন গীতগোবিন্দের অনুপম কোনো স্তোত্র সেলাই হয়ে থাকত সুতায়।
ছোটবেলায় শোনা এক কাব্য মনে পড়ে—‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে…’। আজ মনে হয়, এ কাঁথার ভেতরেই ছিল সেই সূর্য-মায়ের স্নেহের মতোই লুকোনো, কিন্তু সর্বত্র উপস্থিত।
বাঁশের খাটে শুয়ে পড়ি। খাটে কেঁপে কেঁপে ওঠে পুরোনো দিনের কাঠামো, যেভাবে বহুদিন পরে ফিরে আসা প্রেমিকের ছোঁয়ায় কাঁপে পুরোনো চিঠির খাম। বুকের ভেতর হঠাৎ কেঁপে ওঠে একটি দীর্ঘশ্বাস, এ যেন বিদ্যাপতির কণ্ঠে বলা ‘মোরে বাঁচাইও গো’; যেমন তিনি বলেছিলেন রাধার মুখে, আমি বলি স্মৃতির কাছে।
চাঁদ উঠেছে আধেক। পুকুরে তার প্রতিবিম্ব। মা ছোটবেলায় বলতেন, ‘আধভাঙা চাঁদ মানে রাতের শুদ্ধতা।’ সেই চাঁদ দেখি আর বুঝি, আমার জীবন যতটা পূর্ণ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ফাঁকা রয়ে গেছে। এই আধভাঙা চাঁদ যেন আমারই প্রতিবিম্ব।
দূর থেকে শোনা যায় শেয়ালের ডাক। নিঃসঙ্গ রাতের বন্ধু। কাকডাকা ভোরে যেভাবে ‘কৃষ্ণকুমারী’র কণ্ঠে উঠে এসেছিল সেই অতৃপ্ত কান্না, তেমনি এই শেয়ালের ডাক আমার বুকের ভেতর হু হু করে জাগিয়ে তোলে মায়ের গলা। সেই ডাক নেই, সেই হাত নেই, কিন্তু সেই কাঁথাটা আছে। ঠিক যেন গ্রন্থহীন, অথচ প্রাণে ধরা এক অক্ষরবৃত্ত।
আমি চোখ বন্ধ করি। শরীরে কাঁথার ওম, মনের ভেতর মাতৃত্বের ছায়া। আজ আমার কোনো ব্যস্ততা নেই, কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই, কোনো মেইল নেই, আছে শুধু মায়ের সেলাই করা কাঁথা, বাঁশের খাট আর একটি আধভাঙা চাঁদের প্রহর।
এই রাত ফুরিয়ে যাবে জানি। কিন্তু কাঁথার ওই সেলাইগুলো যেন আমার শরীর পেরিয়ে আত্মায় গেঁথে যায়। যেন আমি হয়ে উঠি সেই ছেলের মতো, যে বিদ্যাসাগরের ‘মায়ের ছায়া’ কবিতায় বলেছিল, ‘ছেলে আমার বড় হবে, মা থাকবে না কাছে…’।
আজ মা–ও নেই, আমিও বড় হয়েছি। বড় হওয়ার ক্লান্তি আজ কাঁথার নিচে ঢেকে রাখি। এই গ্রামীণ নিঃশব্দ রাতেই আমি নিজেকে আবিষ্কার করি নতুন করে আরও একবার—মায়ের কোলের পাশে।