মুক্তিকাতর মানুষের পথরেখায় ‘জলকপোত’

সাজেদুল ইসলাম রচিত ‘জলকপোত’ উপন্যাসছবি: সংগৃহীত

‘জলকপোত’ উপন্যাসটি তরুণ কথাসাহিত্যিক সাজেদুল ইসলাম রচিত গ্রামীণ, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। উপন্যাসের গল্পে চিত্রিত হয়েছে গ্রামীণ মানুষের সংগ্রাম, সম্পর্ক, দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবন, বিভাজন ও বহুবিধ সমাজিক জটিলতা। গল্পটি একজন নারীর। সশস্ত্র সংগ্রামে নিবেদিত এক দম্পতির বীরোচিত তৎপরতার আখ্যান। এই দম্পতি সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল—‘লাঙল যার জমি তার হবে’ এই আকাঙ্ক্ষায়। তাদের সংগ্রাম ছিল সুদখোর মহাজন, জোতদার ও প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে।

মূল গল্পে দেখা যায়, নদী-খালবেষ্টিত দক্ষিণ বাংলার অদূরে জিরাকাঠি গ্রামের কচা নদীর খেয়াঘাটের মাঝি নুরু। সারা বছর ঝড়বৃষ্টি ও রোদ উপেক্ষা করে মাঝি সবাইকে পারাপার করে। বিনিময়ে বছরে দুইবার, যখন নতুন ধান ওঠে, তখন গ্রামবাসীর কাছ থেকে ধান পায়। একশ্রেণির মানুষের কাছ থেকে আশা-ভরসা পেলেও তারা পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করে। তবু মাঝি পারাপার করে গ্রামের মানুষকে। লেখক বলছেন, ‘এ যেন ছাগল বলে বিস্বাদ খাইলাম, গেরস্ত কয় প্রাণে মইলাম।’ চরম হতাশার ভেতরেও প্রকৃতিতে ডাওর বা বর্ষাকাল এলে নুরু মাঝি মনে ও শরীরে প্রেম অনুভব করে। তার মনে হয়, ডাওর হলো প্রেম ও কামের কাল। মানুষের প্রজনন মৌসুম। কার্তিক যেমন কুকুরের। ডাওরের জল প্রকৃতির সঙ্গে মানবভূমিকেও উর্বর করে তোলে।

‘জলকপোত’ শুধু উপন্যাস নয়, সমাজের বিচিত্র ক্যানভাস। যেখানে দারিদ্র্য, প্রকৃতি ও মানুষের সংগ্রামের চিত্র মিলেমিশে একাকার।

গ্রামের একসময়কার চেয়ারম্যান হায়দার মোড়লের নামডাক সব জায়গায়। সে তার বুদ্ধি, বিচক্ষণতা দিয়ে নিজস্ব কোনো ধানের চাতাল, বড় নৌকার বহর না থাকা সত্ত্বেও বনে যায় মস্ত বড় কারবারি। জিরাকাঠির সব কৃষকের কৃষিপণ্য তার হাত ধরে বিক্রি হয়। মোড়লের বাইরে কারও যাওয়ার জো নেই। এমনকি অন্য কারবারিরাও ধরনা দিয়ে বসে থাকত হায়দার মোড়লের কাছে। না হলে তাদের মিলগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। সময়ের পরিক্রমায় মোড়ল আধিপত্য হারিয়েছে। দারিদ্র্য, অসমতা ও চরম হতাশার চিত্র তাকেও অবলোকন করতে হয়েছে নিজ চোখে। যুগ যুগ ধরে চলা অন্যায় আধিপত্য আর কৃষক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামে দিলীপ-কাঞ্চু দম্পতি।

দিলীপ পাল জিরাকাঠির প্রতিবাদী যুবক। পেশায় শ্রমিক ও পরিশ্রমী। সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের নজরে আসে সে। একসময় দিলীপ দম্পতি যুক্ত হয় সর্বহারা দলে। আয়ত্ত করে বর্ষাকালীন ও বিপ্লবী রণকৌশল। বিপ্লবী কৌশল হিসেবেই বিস্তৃত পেয়ারাবাগানে গড়ে তোলা হয় বিপ্লবী স্কুল। বিপ্লবীদের জন্য আদর্শ স্থান—ছোট ছোট খাল, ঘন জঙ্গল, ফসলের খেত আর সারি সারি পেয়ারাবাগান। বিপ্লবী স্কুলের নিয়মিত ছাত্র হয়ে ওঠে দিলীপ। একসময় তারা অপারেশনে যাওয়া শুরু করে। বিপ্লবী অপারেশনে কৌশলের ভেতরে কৌশল থাকে। পাঁচজন মিলে একটি ট্রুপস গঠিত হয়। গোপন সংকেত মাধ্যমে এরা মিলিত হয় অপারেশনে। আঞ্চলিক কমান্ডারের সমন্বয়ে চলে এসব ট্রুপস। অথচ কেউ কারও পরিচয় জানে না। ধীরে ধীরে দক্ষ নেতৃত্বে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের পর গ্রামে। বিপ্লবীদের অন্যতম কৌশল ছিল থানা ও ফাঁড়ি দখল করে পেয়ারাবাগানে অস্ত্রের মজুত বাড়ানো। দিনে দিনে পুলিশ সদস্য, মহাজন ও কারবারিদের ঘুম হারাম হয়। বিপ্লবী অপারেশন থেকে আদায় করা খাদ্যশস্য গরিব মানুষের মধ্যে বণ্টন করে বিপ্লবী দল। দলের সদস্যরা মহাজন-জোতদারদের সম্পদ দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তাদের জীবন নিয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে।

আরও পড়ুন

হায়দার মোড়ল গত হওয়ার পর মোবারক মোল্লা তার সবকিছু দখল করে। এত দিনে দিলীপ দম্পতি বিপ্লব সফল করে ঘরে ফিরলেও বিপ্লবের সুফল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। প্রতিপক্ষের চোরা শিকারে জীবননাশ ঘটে দিলীপের। পতিহারা কাঞ্চু পাল আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন শেষ করে মোবারক মোল্লার চাতালে কাজ শুরু করে। শুরু হয় তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়।

দৌলতখানের রিংকু আকন চাতালের নয়া কারবারি। কাঞ্চু পালের প্রেমে দিশাহারা অবস্থা তার। কারবারে তার মন নেই। কাঞ্চু পালের সায় না থাকলেও এ নিয়ে দেনদরবারেরও অন্ত নেই। রিংকু এসবে দমে যাওয়ার পাত্র নয়। মনপুরার সোমেদ বেপারীর মুখে বিপ্লবী বয়ান শুনে রিংকু নয়া বিপ্লবী বনে যায়। সে হয়ে ওঠে কাঞ্চু পালের বিপ্লবী সঙ্গী। শেষে প্রশ্ন ওঠে ধনাঢ্য কারবারি রিংকু বিপ্লব না কাঞ্চুর প্রেমে মজেছে। উপন্যাসে যে সর্বহারা দলের সংগ্রামের কথা বিবৃত হয়েছে, তা হয়তো স্বাধীন বাংলাদেশের কৈশোরকালের গল্প। বিপ্লবীদের আত্মদানের গল্প।

রিংকু আকনের মতো নয়া বিপ্লবীর আগমন নতুন আশার ইঙ্গিত বহন করে। দিলীপের অসমাপ্ত বিপ্লব সুসম্পন্ন করতে কাঞ্চুর সঙ্গী সে। প্রতিশোধের নেশায় কাঞ্চু ও রিংকু হত্যা করে ক্ষীতীশ মন্ডলকে। হায়দার মোড়লের নাতি মেঘনাদ রিহিল হাজির ঘটনাপ্রবাহে। বিদেশে অধ্যয়ন শেষে দেশে ফেরা রিহিলের সঙ্গে বিপ্লবী যোগসূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। হায়দার মোড়লের ভিটায় যুবকের উত্তরাধিকার থাকলেও মাটির সঙ্গে তার সম্পর্ক না থাকায় তাকেও দুই সংস্কৃতির দ্বন্দ্বে পড়তে হয়। রিহিল অনুভব করে, মালিকানা ও সম্পর্ক দুটি ভিন্ন বিষয়। সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক বদলায়।

আরও পড়ুন

মোবারক মোল্লার কারবারি হয়ে ওঠার পেছনে হাত ছিল ক্ষীতীশ মন্ডলদের মতো আরও অনেকের। মোবারক মোল্লা কৃষকের শত্রু। জনতার শত্রু। আখ্যানের শেষে এসে নয়া বিপ্লবী দল মোবারক মোল্লাকে হত্যা করে। সেই সঙ্গে প্রতিপক্ষের আঘাতে দৌলতখানের নয়া কারবারি রিংকু আকনও নিষ্ঠুর রক্তারক্তির শিকারে পরিণত হয়।

একজন অন্যায়ের জন্য রক্ত দিল, অন্যজন ন্যায়ের জন্য। তবে রক্তের রং দেখে তা পৃথক করা গেল না। বিপ্লবী রিংকু আকনের দেহ নাওয়ে তুলল রিহিল, বাসু ও কাঞ্চু। রাতের নদীতে জলকপোতের মতো ভেসে চলল রিংকুর নাও। নতুন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে যেমনটা ভেসে বেড়িয়েছিল একদল যুবক, বিপ্লবী নেশায়। আকনের পাশে বসা কাঞ্চুর চোখে শাওনের বৃষ্টি নামল। লেখকের ভাষ্যে, ‘জীবন ও মরণের দুই পাড়ে দুইজন—মনে হল দীর্ঘ এ রাত ভেঙে আর ভোর হবে না।’

জিরাকাঠি বাজার আর বুধবারের মীরের হাট দেখে নিশ্চয়ই বিপ্লব এখন মুচকি হাসে। মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছে। মহাজন ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট নেই এখন। এত দিনের স্বপ্নহীন চোখ মেলে কৃষক দেখল—তাদের রক্ত এখন কামিনী ফুল হয়ে সুবাস ছড়িয়ে চলেছে এই বর্ষায়।

‘জলকপোত’ শুধু উপন্যাস নয়, সমাজের বিচিত্র ক্যানভাস। যেখানে দারিদ্র্য, প্রকৃতি ও মানুষের সংগ্রামের চিত্র মিলেমিশে একাকার।

একনজরে
বই: জলকপোত
লেখক: সাজেদুল ইসলাম
ধরন: উপন্যাস
প্রকাশক: চন্দ্রাবতী একাডেমি
প্রচ্ছদ: রুবাইয়াত ইবনে নবী
পৃষ্ঠা: ১৩৫
মুদ্রিত মূল্য: ৩৫০ টাকা

সভাপতি, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা