বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাস জানতে আগ্রহী কিংবা এ নিয়ে কাজ করছে ও ভবিষ্যতে করবে, এমন ব্যক্তিদের জন্য এ বইটি অন্ধকারে আলো পাওয়ার মতো উৎস।
বাংলা সাহিত্যকে যেসব আলো আলোকিত করেছে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসটি তার মধ্যে অন্যতম। কেউ বইটি পড়লে সে বাংলা সাহিত্যের রত্নভান্ডার ও ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। এ ছাড়া বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির পেছনে যাঁদের অকৃত্রিম ও দীর্ঘস্থায়ী অবদান রয়েছে, সেসব ব্যক্তির জানা-অজানা অনেক কাহিনির পূর্ণরূপ খুঁজে পাওয়া যায় এই বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাস জানতে আগ্রহী এমন পাঠক হলে এ উপন্যাসটি তাঁর জন্য আলোর দরজা খুলে দেবে।
বইটি লেখা প্রসঙ্গে লেখক যদিও বলেছেন, পূর্ণ ইতিহাস লেখা তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল না; তবু ভারতীয় উপমহাদেশের ১৮৮৩ সাল থেকে ১৯০৭ সালের অনেক ঘটনা এখানে দৃশ্যমান গুরুত্ব পেয়েছে। যে দৃশ্যের মানুষ, স্থান, চরিত্র, ঘটনা ও পারিপার্শ্বিকতায় যুক্ত বিষয়গুলো মৃত কিংবা গত হলেও লেখকের লেখার দক্ষতায় সেগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সাহিত্যিক আর রাজনৈতিক নানা ঘটনাও এ উপন্যাসের পাতায় পাতায় রচিত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ অতীতগুলোকে কল্পনার চেয়েও বেশি বাস্তবিক রূপ দিয়েছে।
‘প্রথম আলো’ উপন্যাসের অনেকটাজুড়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বকবির নিজের পারিবারিক পরিধির নানা চরিত্র ও ঘটনা ছাড়াও ব্যক্তি কবির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় জীবনে প্রভাব, সাংসারিক টানাপোড়েন আর মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কেরও রহস্য রয়েছে এখানে। মা কালীভক্ত শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস আর স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের নানা রূপ প্রকাশিত হয়েছে দীর্ঘ ব্যাখ্যা নিয়ে। আনন্দ পাবলিকেশনের এই বইয়ের প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকৃষ্ণ পরমহংস আর স্বামী বিবেকানন্দের ছবি দেখে সহজে বুঝতে পারলেও আসলেই এই উপন্যাসে এই তিন ব্যক্তির জীবিত সময়কালের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক আর সামাজিক প্রেক্ষাপটের জটিল সমন্বয়ের বর্ণনা বর্ণিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের অমর সব সৃষ্টির পেছনের ব্যক্তিদের ছাড়াও এই জনপদের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জাতীয় ও বিশ্বদরবারে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁরাও লিপিবদ্ধ হয়েছেন লেখকের সুনিপুণ লেখা আর চোখের দূরদৃষ্টির জন্য। লেখকের সৃষ্ট চরিত্র ভরতের পরাধীন জীবনের মতো একসময় ভারতবর্ষও পরাধীন ছিল। স্বাধীনতার সুখ পেতে সমগ্র ভারতবর্ষের লোকেরা সংগ্রামের পথে এগিয়ে চলেছিল।
রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য সিংহের স্বাধীন রাজ্য ত্রিপুরার সেই হতভাগা রাজপুত্র ভরত আর ওডিশার ভূমিসুতার সঙ্গে গল্পের প্রয়োজনে বিভিন্ন চরিত্র যুক্ত হয়েছে। শশিভূষণ, মনমোহিনী, রাধাকিশোর, রাধারমণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাদম্বরী দেবী, কুসুমকুমারী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, জ্ঞানদানন্দিনী, যাদুগোপাল, সুরেন্দ্রনাথ, ভগিনী নিবেদিতা, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল চক্রবর্তী, বারীন, বিপিন, ক্ষুদিরাম বসু, গিরিশচন্দ্র, অমেরন্দ্রনাথ, অভয়চরণ, মৃণালিনী দেবী, অশ্বিনীকুমার, সরলা, নবাব সলিমুল্লাহ—শত শত চরিত্র যুক্ত হয়ে সমগ্র উপন্যাসটি বাস্তবে রূপ পেয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে হেনরি কটন, ব্যামফিল্ড ফুলার, লর্ড কার্জনসহ অনেকের ইংরেজ শাসনব্যবস্থার উপস্থাপন করা হয়েছে ঘটনার বর্ণনা বলার মাধ্যমে।
উপন্যাসে লেখকের দুটি সৃষ্ট চরিত্র হলো ভরত ও ভূমিসুতা। গল্পের প্রয়োজনে কিংবা পাঠকের পড়ার গতি চলমান রাখার উদ্দেশ্যেই হোক, লেখক এই দুটি চরিত্র নিজ কল্পনা থেকে সৃষ্টি করলেও, বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে তারা স্বতন্ত্র হয়ে উপস্থিত হয়েছে। ইতিহাসবিষয়ক ঘটনা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ব্যক্তিজীবনের বর্ণনা দীর্ঘ সময় আলোচনা করা হলেও, এর মধ্য দিয়ে ভরত ও ভূমিসুতা চরিত্র শত ক্লান্তি দূর করে গল্প পড়া চলমান রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
একই সময়ে এই জনপদসহ ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যে রাজার শাসন কিংবা কলকাতাসহ অন্য অনেক রাজ্যে ও দেশে ইংরেজ শাসনের বর্ণনা পাওয়া যায়, ঘটিত নানা রকম ঘটনা ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের উপস্থিতির জন্য। শাসনব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ, ধর্মীয় আচার–আচরণ, সেসময়কার মানুষের বিবেক–বিবেচনা, চিন্তা–চেতনা, আইনের মানদণ্ড, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট অতীত বর্ণনার গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তবে ধরা দিয়েছে।
নারীশিক্ষার প্রসার, বহুবিবাহ বন্ধ, সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত, ইংরেজ সরকারি শিক্ষার পরবর্তী সময়ে দেশীয় শিক্ষার প্রচলন, লন্ডনের মেধাবীদের সঙ্গে একই পরীক্ষায় তাদের টপকিয়ে ভারতীয়দের জয়লাভের ইতিহাস, স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রস্তুতি, বিলেতি কাপড় বর্জন করে দেশি মোটা কাপড়সহ দেশীয় জিনিসের অধিক ব্যবহারের শুভসূচনা করা, শিক্ষার সঙ্গে আধ্যাত্মিক বিষয়ের সংযোগ স্থাপন, বাংলায় থিয়েটার গড়ে ওঠার একাল-সেকাল ইত্যাদি বিষয় নানাভাবে অনেকবার আলোচনায় এসেছে।
বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাস জানতে আগ্রহী কিংবা এ নিয়ে কাজ করছে ও ভবিষ্যতে করবে, এমন ব্যক্তিদের জন্য এ বইটি অন্ধকারে আলো পাওয়ার মতো উৎস।
হাজীপুর, নরসিংদী