১৯৭৩ সালে খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয় হুমায়ূন আহমেদের শঙ্খনীল কারাগার। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। উপন্যাসটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর একান্ত কাছের দুজন মানুষ—আহমদ ছফা ও আনিস সাবেতকে। প্রথম প্রকাশের ভূমিকায় হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন—‘সোমেন চন্দের লেখা অসাধারণ ছোটগল্প “ইঁদুর” পড়ার পরই নিম্নমধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার একটা সুতীব্র ইচ্ছা হয়। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার ও মনসুবিজন নামে তিনটি আলাদা গল্প প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলি। নিজের ওপরে বিশ্বাসের অভাবের জন্যই লেখাগুলি দীর্ঘদিন আড়ালে পড়ে থাকে। যা-ই হোক, আহমদ ছফা ও বন্ধু রফিক কায়সারের আগ্রহে নন্দিত নরকে প্রকাশিত হয় মাসছয়েক আগে। এবার প্রকাশিত হলো শঙ্খনীল কারাগার।’
শঙ্খনীল কারাগার হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় উপন্যাস হলেও এর প্রতিটি পাতায় দক্ষ জীবনশিল্পীর ছোঁয়া পাওয়া যায়। প্রতিটি চরিত্রকে লেখক অত্যন্ত মমতার সঙ্গে সৃষ্টি করেছেন। নিম্নমধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে শঙ্খনীল কারাগার-এর মতো অপূর্ব কোমল উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে খুব কমই লেখা হয়েছে। ‘কারা কানন’ নামের এক প্রকাণ্ড বাড়ি থেকে শুরু হয় কাহিনির সূত্রপাত। সেই বাড়ির শিরিন সুলতানা নামক উনিশ বছর বয়সী মেয়ে রোজ সকালে ছাদে উঠে হারমোনিয়ামে গলা সাধতেন। সেই ছাদের চিলেকোঠায় আশ্রিত হিসেবে থাকতেন বিএ পাস করে চাকরির খোঁজ করতে আসা গ্রামের এক ছেলে, যার নাম আজহার হোসেন। আজহার ভেতরে-ভেতরে পছন্দ করতেন শিরিন সুলতানাকে। মনে মনে নিজের করে চাইতেন। একদিন তিনি পেয়ে যান সুলতানকে।
দরিদ্র আজহার ১৫০ টাকা ভাড়ার এক বাসায় সংসার শুরু করেন—স্ত্রী এবং এক কন্যাসন্তানকে নিয়ে! এই কন্যাসন্তানটি শিরিন সুলতানার আগের সংসারের। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তাঁর আগের সংসার ভেঙে যায়। আগের স্বামীর নাম ছিল আবিদ হোসেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের এক মেয়ে সব ছেড়ে সংসার করতে থাকেন এক দরিদ্র ছেলের সঙ্গে। তার অতীত বলতে কেবল ওই কন্যাসন্তানটি, যার নাম রাবেয়া।
এরপর একে একে তাদের সংসারে আসে বড় ছেলে খোকা, তারপর রুনু, ঝুনু, মন্টু এবং সর্বশেষ নিনু। নিনু হওয়ার সময় ২৩ বছরের সংসারজীবনের সমাপ্তি করে মারা যান শিরিন সুলতানা। এই ২৩ বছরে তিনি কখনো একবারের জন্যও বাবার বাড়িতে যাননি, গান ভালোবাসা মানুষটি ভুল করেও আর কখনো গান করেননি, ভালোবাসতে পারেননি নিজের স্বামী সন্তানকে। প্রথম বিবাহবিচ্ছেদের পাওয়া ব্যথা আর স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার জন্যই শিরিন সুলতানা কখনো আর স্বাভাবিক হতে পারেননি, নিজের চারপাশে তৈরি করে রেখেছিলেন এক অদৃশ্য দেয়াল।
আজহার হোসেনও অনেকটা থেকেও নেই—এ ধরনের মানুষ। সব সময় কী এক হীনমন্যতায় ভোগেন, খুব চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি খোলস থেকে বেরিয়ে এসে এক হাসিখুশি মানুষে পরিণত হন। সম্ভবত তাঁর ধারণা ছিল তিনি শিরিন সুলতানার স্বামী হওয়ার যোগ্য নন। উচ্চ বংশের এমএ পড়া, গান জানা একটা মেয়ের স্বামী হওয়ার যোগ্যতা সত্যিই তার ছিল না। সে কারণেই নিজেকে সবকিছু থেকে চিরকাল আড়াল করে এসেছেন।
তাদের বড় ছেলে খোকা, তার জবানিতেই সমগ্র উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। সে কলেজের অধ্যাপক। মনে মনে কিটকি নামের এক খালাতো বোনকে ভালোবাসত, কিন্তু কখনো প্রকাশ করেনি। তার ধারণা ছিল কিটকি মেয়েটাও তাকে ভালোবাসে। কিটকির অন্য এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়! নিজের মনের কষ্ট সে কাউকে বুঝতে দেয়নি। মায়ের ভালোবাসা কখনোই অনুভব করার সুযোগ হয়নি তার। এটা অবশ্য তাদের সব ভাইবোনের ক্ষেত্রেই সত্য। এ জন্য মনে এক গভীর বেদনা ছিল। নিজের কথা আর সবার মতো সে-ও লুকিয়ে রাখে। কাছের বন্ধু বলতে বড় বোন রাবেয়া। রাবেয়ারও কাছের বন্ধু সে। বিয়ের বয়স পার হলেও বিয়ে হয়নি রাবেয়ার। আর যে বিয়ে হবে না, সেটাও সবাই ভালোভাবেই জানে। সে কারণেই তার আগেই ছোট বোন রুনুর বিয়ের কথা ওঠে।
রুনুর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল মনসুরের সঙ্গে। কিন্তু ভুল-বোঝাবুঝির জন্য বিয়েটা আর হয় না। বিয়ে হয় ঝুনুর সঙ্গে। সেই থেকে বদলে যেতে থাকে রুনু। বুকভরা কষ্ট নিয়েই একসময় মৃত্যু হয় তার। সংসারের মধ্যে মন্টু একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির ছেলে, এক আলাদা দুনিয়ার মানুষ। লেখালেখি করে, পত্রপত্রিকায় লেখা ছাঁপা হয়; এমনকি তার দুটি বইও বের হয়েছে। নিজের দুনিয়া নিয়ে সে ব্যস্ত থাকে। ছোট্ট নিনুও নিজের এক দুনিয়ায় নিজের মতো করে বেড়ে উঠছে, তার একটা আলাদা জগৎ ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে।
রাবেয়াও একসময় আবার নতুন করে কলেজে ভর্তি হয়, পড়াশোনা করে চাকরি নেয় বাড়ি থেকে দূরের এক স্কুলে। কলেজে থাকতে পড়াশোনা বাদ দিয়েছিল সে। কালো চেহারার জন্য ছেলেরা তাকে মা কালী বলেছিল—সেই দুঃখে সে আর কলেজে যায়নি। বাবা তার মেয়ের মনের কষ্ট দূর করার জন্য ফরসা করার ক্রিম এনে দেন। যেটা ছিল রাবেয়ার কাছে প্রচণ্ড মূল্যবান—২০ টাকায় কেনা এক কৌটা ভালোবাসা। কিন্তু সে জানে ইনি তার জন্মদাতা বাবা নয়! মাত্র ১১ বছর বয়স থেকে সে এই করুণ সত্যটা জানে। বুকে কষ্ট চেপে রেখেছে চিরকাল, কাউকে সেই কষ্টের কথা কখনো বলেনি। তবে একটি হৃদয়স্পর্শী চিঠির মাধ্যমে রাবেয়া বহুদিনের বহু কষ্টের কথা লিখে জানায়, তার সবচেয়ে আদরের ভাই এবং কাছের মানুষ খোকাকে। চিঠিতে থাকে তার নিজের অতীত ইতিহাস, মায়ের কথা, বাবার কথা, আবিদ হোসেনের কথা, রুনু, ঝুনু, মন্টু, নিনু আর খোকার কথা।
একই পরিবারের এতগুলো মানুষ কাছাকাছি থেকেও কেউ কখনো বুঝতে পারে না কার মনে কী চলছে! প্রতিটি মানুষই তার নিজের চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে রাখে। যে দেয়ালের মধ্যে কখনো কেউ প্রবেশ করতে পারে না, যে দেয়ালের ভেতরের কথাগুলো কখনো কেউ জানতে পারে না—এই অদৃশ্য দেয়ালের নামই শঙ্খনীল কারাগার।
শঙ্খনীল কারাগারে একটা অপূর্ব ছন্দময়তা লক্ষ করা যায়। জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো, ছোট ছোট ভালো লাগাগুলো এত চমৎকারভাবে এসেছে এখানে যে ‘খোকা’ চরিত্রটির সঙ্গে মুহূর্তেই পাঠকের একাত্মতাবোধ হয়। বারবার মনে হয়, এ তো আমার গল্প, এ তো আমাদের গল্প। মধ্যবিত্তের আবেগ ও অনুভূতির সূক্ষ্ম বয়ান সংলাপে সংলাপে অপূর্বভাবে ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে শব্দের নিপুণ কারিগর।
শঙ্খনীল কারাগারের ভাষা কবিতার মতোই কোমল ও ছন্দময়। মধ্যবিত্তের আবেগমাখা এমন কোমল গল্প মনে হয় শুধু হুমায়ূন আহমেদের দ্বারাই লেখা সম্ভব। শব্দকারিগরের শব্দের গাঁথুনিতে শঙ্খনীল কারাগার হয়ে উঠেছে মধ্যবিত্ত সমাজের এক নিখুঁত চিত্রায়ণ।
নতুন পাড়া, সুনামগঞ্জ