এক কাপ হ্যালুসিনেশন

ছবি: এআই/বন্ধুসভা
বৃষ্টির পানিতে চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গেছে। শার্টের খুঁট দিয়ে চশমাটা মুছে আবার তাকালাম। বারান্দায় কেউ নেই।

বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ঝুলে থাকা তারের স্তূপ আর কংক্রিটের অট্টালিকার এই শহরে মুক্ত আকাশ দেখাটা সত্যিই দুষ্কর। বর্ষার শেষার্ধ চলছে। অথচ কালচে মেঘে ছেয়ে যাওয়া আকাশ শেষ কবে দেখেছি, কিছুতেই মনে করতে পারছি না। শ্রাবণের এই সময়ে আকাশটা কেমন ফ্যাকাসে, মনমরা রোগীর মতো হয়ে থাকে। আজ অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন। দুপুর গড়াতেই আকাশ রং বদলে ফেলল। ধূসর থেকে গাঢ় নীল, তারপর সেখান থেকে ছায়া-কালো। যেন কোনো এক অভিমানী শিল্পী তার ক্যানভাসে বারবার ভুল রং মেশাচ্ছে। বাতাসেরও আজ বিশ্রাম নেই। ক্ষ্যাপাটে আচরণ করছে। রাস্তার ধুলা, শুকনা পাতা আর ছেঁড়া পলিথিন উড়িয়ে নিয়ে এমন এক ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করেছে, যা দেখলে গা ছমছম করে। ব্যস্ত রাস্তায় দম ফেলার ফুরসত নেই কারও। সবাই ছুটছে।

বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। পাঁচতলার বারান্দা থেকে এই খ্যাপাটে প্রকৃতি আর মানুষের ছোটাছুটি দেখতে বেশ লাগে। মনে হয় যেন বিশাল এক সিনেমার পর্দায় কোনো পরাবাস্তব দৃশ্য দেখছি। বাতাসটা দমকা হাওয়ার মতো এসে ঝাপটা দিচ্ছে। আমার এলোমেলো চুলগুলো কপালের ওপর পাগলের মতো নাচছে। হঠাৎ করেই যেন আকাশ তার সব অভিমান ঝেড়ে ফেলতে চাইল। কান ফাটানো এক শব্দে বাজ পড়ল কাছাকাছি কোথাও। তারপরই ঝমঝমিয়ে নামল বৃষ্টি। প্রথম কয়েক ফোঁটা চোখেমুখে এসে লাগল। ভেজা মাটির গন্ধের বদলে ভেজা কংক্রিটের এক অদ্ভুত গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিল।

রাস্তায় এক বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হলো। যে যার মতো দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তাঘাট ফাঁকা। শুধু বৃষ্টি আর বাতাসের যুগল তাণ্ডব। আমার বাসার সামনে যে দুটো টিনের চালের ঘর আছে, সেখানের বৃষ্টির শব্দ বড় তীব্রভাবে কানে বাজে। মনে হয় যেন হাজার হাজার নুড়ি পাথর কেউ একসঙ্গে টিনের চালে ছুড়ে মারছে। এই শব্দ গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। ছোটবেলায় এমন বৃষ্টির দিনে উঠোনে কদম ফুলের গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতাম।

‘তোমার চা।’
একটা তীক্ষ্ণ পরিচিত মেয়েলি গলা। চমকে পেছনে ফিরলাম। রুপা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ধোঁয়াওঠা চায়ের কাপ। আকাশি রঙের শাড়িতে তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। কপালের নীল টিপটা যেন এই মেঘলা দিনে এক টুকরা আকাশ। ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে রইলাম।
‘কী হলো? হাঁ করে কী দেখছ? চা ধরো।’
হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলাম। রুপা পাশে এসে দাঁড়াল। তার ভেজা চুলের গন্ধ আমার নাকে এসে লাগল। এই গন্ধটা আমার খুব পরিচিত।
‘চলো আজ বৃষ্টিতে ভিজি,’ রুপা আবদারের সুরে বলল।
‘না। ঠান্ডা লাগবে। তারপর ঘুমের মধ্যে দেখবে নাক দিয়ে জাহাজের সাইরেন বাজছে।’
‘আমার কিছু হবে না। আমি যাই?’
‘না।’
‘কেন?’ তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়।
‘আমি বলছি তাই।’ আমার কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা।

আরও পড়ুন

রুপা খিলখিল করে হেসে উঠল। ‘তুমি বললেই হলো নাকি? গণতান্ত্রিক দেশে ডিক্টেটরশিপ?’
হঠাৎ আমার চুলে তীব্র এক টান পড়ল। ‘আও!’ বলে চিৎকার করে উঠলাম। ‘চুল টানছ কেন?’
‘শাস্তি। হিটলারি ফলানোর শাস্তি।’ সে মুখ ভেঙিয়ে বলল।
‘কী বলব আর, ক্ষমতা থাকলে তো মানুষ দেখাতোই।’ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম।
‘ওহ্‌, তা–ই? তা কী দেখাতে শুনি?’
‘প্রথমেই তোমার ওই বিচ্ছিরি গান গাওয়া বন্ধ করতাম।’
রুপা চোখ বড় বড় করে তাকাল। ‘মানে? আমার গলা খারাপ?’
‘অবশ্যই নয়। কোকিলের মতো মিষ্টি। কিন্তু কোকিল আর কাকের রং এক তো, তাই মাঝেমধ্যে গুলিয়ে ফেলি।’
‘কি!’ সে আমার দিকে তেড়ে আসার ভঙ্গি করল। আমি তাড়াতাড়ি এক পা পিছিয়ে গেলাম। রুপার এই কপট রাগটা বেশ পরিচিত। এই রাগের আড়ালে যে কি পরিমাণ ভালোবাসা লুকিয়ে আছে!

‘এই, বলো না শাড়িটাতে কেমন লাগছে?’ রুপা হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলাল।
ভালো করে তার দিকে তাকালাম। ‘আগেকার দিনে আকাশে একধরনের পাখি উড়ত। ঠোঁট বাঁকানো, বিশাল ডানা...’।
‘থামো!’ রুপা আমার মুখ চেপে ধরল। ‘আমি জানি তুমি কী বলবে। আমি কি দেখতে শকুনের মতো?’
তার হাত সরিয়ে হাসলাম। ‘কখন বললাম তুমি শকুনের মতো? আমি তো বলতে যাচ্ছিলাম, ফিনিক্স, ভাগ্যবতী পাখি।’
রুপা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ফিক করে হেসে ফেলল, ‘তাহলে বদলালাম অবশেষে। শকুন থেকে ফিনিক্স।’
দুজনই চুপচাপ বৃষ্টি দেখতে লাগলাম। এই নীরবতাও ভীষণ সুন্দর। কতক্ষণ কেটে গেল জানি না।

‘ভাই!’
একটা গম্ভীর, শান্ত আওয়াজ। পাশের ফ্ল্যাটের কানুক ভাই। ভদ্রলোক ব্যাংকে চাকরি করেন। ভীষণ বাস্তববাদী মানুষ।
‘ভাই, কার সঙ্গে কথা বলেন?’
আমি চকিতে ডানদিকে তাকালাম। ‘এই মানে... রুপার সঙ্গে।’

বৃষ্টির পানিতে চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গেছে। শার্টের খুঁট দিয়ে চশমাটা মুছে আবার তাকালাম। বারান্দায় কেউ নেই। শুধু একটা খালি চেয়ার আর টিনের চালে ঝমঝম করে পড়া বৃষ্টির শব্দ। আমার বুকটা ধক করে উঠল।
কানুক ভাই উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘আপনার শরীর ঠিক আছে তো? রাতে ঠিকমতো ঘুমান নাই? ওষুধ আবার ছেড়ে দিয়েছেন নাকি?’
‘না না, ঘুমিয়েছি তো।’ ক্ষীণ স্বরে উত্তরটা দিয়ে ঘরে চলে এলাম। বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগছে। একটা শীতল স্রোত যেন শিরদাঁড়া বেয়ে নিচে নেমে গেল।

রুপা আর আমি আলাদা হয়েছি কয়েক বসন্ত আগে। ঠিক করে বললে, তিন বছর সাত মাস। এরপর সে কোথায় আছে, কেমন আছে, কিছুই জানি না। জানার চেষ্টাও করিনি। তবে আমার এক অদ্ভুত ক্ষমতা জন্মেছে। যখনই কাউকে তীব্রভাবে মনে করি, সে আমার সামনে চলে আসে। আমার সঙ্গে কথা বলে, হাসে, ঠিক আগের মতো। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম হ্যালুসিনেশন। ডাক্তার বলেন, এটা নাকি সিজোফ্রেনিয়ারও লক্ষণ। আমি অবশ্য এসব কঠিন নামের মারপ্যাঁচ বুঝি না। আমি শুধু জানি, রুপা আমার কাছে আসে।

রুমে ঢুকে টেবিলে চায়ের কাপটা রাখলাম। ধোঁয়া উড়ছে এখনো। কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলাম। মিষ্টিটা একটু বেশিই হয়েছে। রুপা বরাবরই আমার চায়ে বেশি মিষ্টি দিয়ে ফেলে। এটা নিয়েও আমাদের কত খুনসুটি হতো। কিন্তু...এই চা-টা এখানে এল কীভাবে? এটাও কি আমার হ্যালুসিনেশন? মনকে প্রশ্ন করি। মন কোনো উত্তর দেয় না।

বাইরে বৃষ্টির তীব্রতা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বাতাসের বেগ। জানালার কাঁচের ওপর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আছড়ে পড়ে অদ্ভুত এক নকশা তৈরি করছে। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। রাস্তার জল বেড়ে এখন প্রায় কোমর সমান। একটা রিকশা অর্ধেক ডুবেও এগিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।

হঠাৎ মনে হলো, বৃষ্টির এই একটানা শব্দের মধ্যেও অন্য একটা সুর মিশে আছে। খুব চেনা একটা সুর। রুপার হাসির আওয়াজ। দ্রুত পেছনে ফিরলাম। ঘরটা আগের মতোই খালি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, রুপা এখানেই কোথাও আছে। হয়তো খাটের আড়ালে লুকিয়ে আছে, নয়তো পর্দার পেছনে। আমার সঙ্গে তার এই লুকোচুরি খেলাটা খুব প্রিয় ছিল।
‘রুপা! রুপা!’ ফিসফিস করে ডাকলাম।
কোনো সাড়া নেই। শুধু বৃষ্টির শব্দ। বুকের ভেতরকার শূন্যতাটা ক্রমেই বাড়ছে। এই শূন্যতা আমার পরিচিত। রুপা চলে গেলেই এটা আমার সঙ্গী হয়। আবার জানালার কাছে ফিরে এলাম।

আরও পড়ুন

কত স্মৃতি, কত কথা মনে পড়ছে। রুপার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে। সম্পর্কটা খুব দ্রুতই পরিণতি পায়। আমরা বিয়ে করি। সবকিছু স্বপ্নের মতোই সুন্দর ছিল। স্বপ্ন একসময় ভাঙে। আমাদেরও ভেঙেছিল। খুব ছোট একটা ভুল–বোঝাবুঝি থেকে শুরু। তারপর সেটা বাড়তে বাড়তে এমন একপর্যায়ে পৌঁছাল যে আমরা আর একসঙ্গে থাকতে পারলাম না।
এখনো মনে হয়, যদি সেদিন একটু ধৈর্য ধরতাম, যদি রুপাকে বোঝার চেষ্টা করতাম, তাহলে হয়তো আজ সে আমার সঙ্গেই থাকত। কিন্তু সময় তো আর পেছনে ফেরে না। এখন শুধু স্মৃতি আর এই হ্যালুসিনেশনই আমার সম্বল।

টেবিলের ওপর রাখা চায়ের কাপটার দিকে চোখ গেল। চা এখনো শেষ হয়নি। কাপটা হাতে নিয়ে বাকিটুকু এক চুমুকে শেষ করে ফেললাম।
ঠিক তখনই মুঠোফোনটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। সাধারণত অচেনা নম্বর ধরি না। কিন্তু আজ কেন জানি ধরতে ইচ্ছা হলো।
‘হ্যালো।’ আমি বললাম।
ওপাশ থেকে এক ভদ্রলোকের গলা ভেসে এল। ‘শুনতে পাচ্ছেন?’
‘জি, কে বলছেন?’
‘আমি সিটি হসপিটাল থেকে বলছি। আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দেওয়ার জন্য ফোন করেছি।’
বুকের ভেতরটা কেমন ধক করে উঠল। ‘কী হয়েছে?’
‘রুপা নামের কাউকে চেনেন? উনি আপনার নামটাই ইমারজেন্সি কন্টাক্ট হিসেবে দিয়ে গিয়েছেন।’
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগল। গলার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ। কোনোমতে বললাম, ‘জি, চিনি। ও... ও আমার...’।
‘উনি একটু আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায়...।’

ভদ্রলোক কী বলছেন, কানে কিছুই ঢুকছে না। আমার চোখের সামনে পুরো পৃথিবীটা যেন ঘুরছে। মনে হচ্ছে, যেন এক গভীর খাদে তলিয়ে যাচ্ছি। হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল।
টলতে টলতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি এখনো পড়ছে। ঠিক আগের মতোই। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। বাতাস বইছে। কিন্তু আমার কাছে সবকিছু অর্থহীন মনে হচ্ছে।
তাহলে বারান্দায় যে এসেছিল, সে কে ছিল? হাতে চায়ের কাপটা কে দিয়েছিল? যার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বললাম, হাসাহাসি করলাম, সে কে? মস্তিষ্ক আর কোনো যুক্তি মানতে চাইছে না।

হঠাৎ মনে হলো, রুপা কোথাও যায়নি। সে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছি। ফিসফিস করে ডাকলাম, ‘রুপা!’ কেউ সাড়া দিল না। শুধু অনন্তকালের বৃষ্টি ঝরতে লাগল।

শিক্ষার্থী, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিলেট