আবিদ ঘরে ঢুকে কাঠের চেয়ারটা টেনে নিয়ে অগত্যা ধপাস করে বসে পড়ে। একটু পর হাত বাড়িয়ে চিলেকোঠার থাই কাচের ছোট্ট জানালাটা খুলে দেয়।
লকলকিয়ে বেড়ে ওঠা মাধবীলতার বাহারি ফুলের সৌরভে আবিদ ঢুকে পড়ল স্বপ্ন নীড়ে। গেটের পাশে বসা বুড়ো দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল, ‘মামা, এক রুমের একটা ভালো বাসা চাই। হবে?’
দারোয়ান কফ বসা গলায় উত্তর দিল, ‘না বাবা, ব্যাচেলর ভাড়া দেব না।’
আবিদ কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এসে আগ্রহভরে দেখল গেটের মাথায় প্যাঁচানো লতার শাখে শাখে ফোটা মাধবীকুঞ্জ। ওর মনে হচ্ছে যেন ভ্রমর হয়ে ফুলে ফুলে কাটিয়ে দেয় একজনম। মন থেকে বাড়িওয়ালার রুচিবোধের প্রশংসা না করে পারেনি তখন। বাড়ির সামনে আস্ত একটা ফুলের গাছ, নিচে সারি সারি ফুলের টব। সবকিছুই কেমন যেন স্বপ্নময়।
আবিদ অযাচিত চিন্তা বাদ দিয়ে এ গলি-ও গলি ঘুরে ঘুরে বাসা খুঁজতে লাগল। কোথাও মন সায় দিচ্ছে না; এই লাভ লেন আবাসিকের মতো তাকে কোথাও টানেনি আর। ঘুরেফিরে শেষে উঠে পড়ল স্বপ্ন নীড়ের পাশে স্মৃতি মহলের চিলেকোঠায়।
দুবছর আগের কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে আবিদের চোখের সামনে। কেমন রোমাঞ্চকর দিন ছিল সেসব। কিন্তু আজ কেমন মনমরা হয়ে স্মৃতি মহলে বসবাসের ইতি টানতে বসেছে সে।
আবিদ জিনিসপত্তর গুছিয়েছে দিন দুয়েক আগে। আগামীকাল ভোরে এক কাপড়ে বেরিয়ে যাওয়া যাবে দেখে সে বিষয়ে ভাবনা নেই আর। তবে শেষ রাতটা যেন কাটতে চাচ্ছে না। দুরূহ একটা কাজ পড়ে আছে, এ কাজ করার সাহস করেনি কোনো দিন। আজ রাতের মধ্যেই কাজটি শেষ করতে হবে তাকে। ভোরের আলো ফোটার পর আর এক ঘণ্টাও সহ্য করবে না বাড়ির মালিক। আবিদ ভাবল, রাতের মধ্যে এত বানডাকা কথার ভাণ্ড কী করে আর শেষ করা যায়! জমিত সিঞ্চিত কথাগুলো উগরে পড়তে চাচ্ছে কলমের মুখ দিয়ে। মনের অস্তিরতা ও হাতের অসাড়তায় ততটা পেরে উঠছে না ও।
ঘর থেকে পা বাড়ালেই ছাদ; উতলা মনে শূন্য ছাদে কিছুক্ষণ পা চালাল আবিদ। সুনির্মল একটা রাত, আকাশের বুকে গোলগাল চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে ধৃষ্টতা ছড়িয়েছে ছাদময়। কিন্তু কংক্রিটের ঢালাই করা শ্যামল ছাদে শেওলা জমে সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও নেই আর। নেই কোনো ফুলের টব, কার্নিশে নেই কোনো মনোহারি রঙের প্রলেপ। একেবারেই ভাবরসহীন। শিল্প ও সৌন্দর্যের যেন কোনো আবেদনই নেই বাড়ির মালিকের কাছে। তবু বাড়িটির চিলেকোঠা কিছুটা সুন্দর পাশের বাসার জন্য। সঙ্গদোষে লোহা ভাসে বলেই এ বাড়িতে মানুষ বসবাস করতে পারছে; নয়তো মালিকের কঞ্জুস মন আর হাল ফ্যাশনের বাড়িতে মানুষ ঢুঁ মেরেও দেখত বলে মনে হয় না। ঘিয়ের গন্ধে ছালা বিক্রির মতো আশপাশের পরিবেশ দেখে আবিদের এ বাড়িতে উঠতে এত চিন্তা করতে হয়নি।
আবিদ ছাদে হাঁটছে মৃদুভাবে আর দীর্ঘশ্বাসে টেনে নিচ্ছে সুবাসিত ফুলের ঘ্রাণ। পাশের ছাদটি ফুলে-ফলে পরিপূর্ণ। ছোট্ট ছোট্ট কলমিগাছে ঝুলে আছে ফলপাকড়। নানা রঙের বাহারি ফুল; নিচের দিক থেকে গলা টেনে ছাদে উঠে এসেছে মাধবীলতা। ছোট দেহের ফুলগুলোরই বা কী আবেদন ফুলপ্রেমিকের কাছে! আবিদ চাঁদনিরাতের আলো–আঁধারিতে এক পলকে দেখল সেসব। শুধু আবিদ নয়, পাখিরাও দুর্বল পাশের ছাদটার প্রতি। ঘুমের আড়মোড়া ভেঙে পুবাকাশ লালের আভা ছিটানোর আগেই তারা দল বেঁধে হাজির হয়। বেশির ভাগই দেখা যায় জোটবদ্ধ। কী আশ্চর্য! পশু–পাখিরাও নির্মল সৌন্দর্য হরণে মেতে ওঠে।
আবিদ খানিক ভাবল, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্য কেবল ফুলের জন্য। আর অর্ধেক সৌন্দর্য বিশেষ ফুলের জন্য। ঠিক ফুল নয়, ফুলের মতোই দেখতে নারী নামক মানুষের জন্য। প্রকৃতিতে তারা নিঃসঙ্গ থাকলেও সুন্দর, আবার পুরুষের পাশে থাকলে দ্বিগুণ সুন্দর। উদ্ভট চিন্তার জালের ঘেরে আটকে পড়ে আবিদ। সুবিশাল আকাশের নিচে খোলা ছাদে সে একা। নির্জনে নিঃসঙ্গের মতোই একেবারে নীরব। থেকে থেকে মিষ্টি হাওয়া বুকে ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে উঁচু উঁচু ভবনের মাথা ছুঁয়ে।
আবিদ ঘরে ঢুকে কাঠের চেয়ারটা টেনে নিয়ে অগত্যা ধপাস করে বসে পড়ে। একটু পর হাত বাড়িয়ে চিলেকোঠার থাই কাচের ছোট্ট জানালাটা খুলে দেয়। জানালার শিকের ফাঁকে চাঁদের টুকরো টুকরো আলো ঢুকে পড়েছে কাঠের টেবিলটায়। দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে একটা মোমবাতি ধরাল সে। সোনালি আলোয় টেবিল খানিকটা উজ্জ্বল হলো। বেশ কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে নিল ডায়েরি থেকে। মোমবাতির আলোয় পাতাগুলো কাঁচা হলুদের মতো দেখাচ্ছে। কলম হাতে নিয়ে অনেক্ষণ বসে রইল চুপচাপ। কী লিখবে খুঁজে পাচ্ছে না। কথা জমতে জমতে সুউচ্চ পাহাড়ের মতো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোন দিক থেকে শুরু করবে, ভেবেই পাচ্ছে না আবিদ। ভাবনার দোলাচলে গড়িয়ে যাচ্ছে রাতদুপুর।
রাতের বয়স বেড়ে চললে আবিদ ভাবল, শুধু শুধু আর কালবিলম্ব নয়। লিখতে গিয়ে এত আদিখ্যেতা দেখানো কেন! প্রিয় মাধবীলতা দিয়ে শুরু করলে কেমন হয়? না, প্রিয় কেন বলব; সে তো আমাকে চেনে না, জানে না। ‘প্রিয়’ সম্বোধন করাটা অনধিকারচর্চা ও আলগা অধিকার ফলানোর মতো হবে। তাহলে চিরকুট লিখছি কেন? দিনলিপিই লিখব। আচ্ছা, যদি লেখাগুলো আস্ত একটা চিঠির আদলে লিখি, তাহলে কেমন হয়? বোকাসোকা মনের ভুলে ভরা বানানের লেখাগুলো ওর মনমতো হবে কি? জানি না, হয়তো হবে না। শঙ্কিত মনে ভাবতে ভাবতে ওর আঙুলে জড়িয়ে থাকা কলমটা স্মৃতি রোমন্থনের মতো ধীরগতিতে চলতে শুরু করে।
(চলবে...)
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়