অঞ্জলি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রীতিশ বাবু শুধু আমার সহকর্মীই নন, ভালো বন্ধুও বটে। রাজবাড়ী সরকারি কলেজে যোগদানের পর থেকেই ওনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করা, সন্ধ্যায় ডিসি বাংলোয় ব‍্যাডমিন্টন খেলা, হোস্টেলে দাবা খেলতে বসা—সবকিছুতেই যেন দুজনে একাকার।

পাংশা উপজেলার হাবাসপুরে প্রীতিশ বাবুদের বাড়ি। আমার গ্রামে যাওয়ার পথেই পড়ে তাঁর বাড়ি। এ জন্যও ঘনিষ্ঠতা হয়তো একটু বেশি।

আমি ভালো শ্রোতা। প্রীতিশ বাবু ভালো গল্পকার। তিনি গল্প লেখেন, গল্প বলেন। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। বেশ রস দিয়ে গল্প বলতে পারেন। বাচনভঙ্গিও সুন্দর, আকর্ষণীয়। মনোযোগ দিয়ে শুনলে যে কেউ সহজেই তাঁর ভক্ত হয়ে যাবে।

প্রীতিশ বাবু গল্প বলেন। বিভিন্ন রকম গল্প। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ব‍্যক্তিগত—সব। তাঁর মুখে হাসির গল্প শুনলে যেমন হাসি পায়, তেমনি করুণ কাহিনি শুনলেও কান্না এসে যায়। প্রতিটি গল্প তিনি প্রাণবন্ত করে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। বলার মাধ্যমে যেন ঘটনাগুলো সামনে নিয়ে আসেন। বিভিন্ন চরিত্রকে জীবন্ত করে তোলেন।

গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল। চোখ দুটো মাটির দিকে। বুঝলাম, লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। একটু হালকা করার জন্য বললাম, ‘তোমার ফুলগুলো সুন্দর। কোথা থেকে তুললে? ’

তাঁর গাঁয়ের একটা গল্প তিনি প্রায়ই বলতে বসেন। কিছুটা শুরুও করেন। কিন্তু শেষ করেন না। তিনি বলেন, ঘটনা নিজের চোখে দেখা।
তাঁদের গাঁয়ে এক গৃহবধূ আছে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফুল তুলতে যায়। আঁচল ভরে ফুল তোলে।
: তারপর?
তারপর আর বলেন না। বারবার অনুরোধ করার পরও বলেন না। যেন পাঠকের কৌতূহল জাগানোই উদ্দেশ্য।

এক পূর্ণিমা রাতে হোস্টেল ভবনের ছাদে বসে আছি। প্রীতিশ বাবুকে অনুরোধ করলাম সেই গল্পটা শেষ করতে। তিনি শুরু করলেন, ‘ঝড়, বৃষ্টি, গ্রীষ্ম, বর্ষা যা–ই হোক, বধূটি ঘুম থেকে উঠে বাগানে যাবেই। যেন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও তাকে যেতেই হবে। আঁচল ভরে ফুল তুলতেই হবে। তাকে দেখে মনে হয়, সে বুঝি কারও কাছে কড়ারে বাঁধা।’
: তারপর?
তারপর আর কিছু বলেন না। এদিকে গল্পটা শোনার জন্য আমিও কেমন উদগ্রীব হয়ে থাকি।

মনে পড়ে, অঞ্জলিও একসময় প্রতিদিন সকালে ফুল তুলত। ফুল তোলার জন্য ভোরে উঠত। আমাদের উঠোনের ওপর দিয়ে পুব পাড়ায় যেত। আমার ঘরের কাছে আসামাত্রই ভেতরে উঁকি দেওয়া ছিল তার নিত্যদিনের অভ্যাস। কোনো দিন আমার চোখে চোখ পড়ত, কোনো দিন পড়ত না।
আড়াল থেকে খেয়াল করতাম, আমাকে দেখতে না পেলে তার উঁকিঝুঁকি বেড়ে যেত। সেই দৃশ্য দেখে খুব ভালো লাগত।

প্রীতিশ বাবুর আরেকটা ভালো গুণ ছিল। তিনি ভালো গান গাইতে পারতেন। প্রায়ই রাতের বেলা হোস্টেলের ছাদে গানের আসর বসত। ভীষণ দরদ দিয়ে গান গাইতেন। আমার অনুরোধে প্রায়ই ‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম...’ গানটা গাইতেন। গান শেষ হলেও রেশ হৃদয়ে থেকে যেত।

মনে পড়ে, একদিন ভোরবেলায় ফুল তুলে ফেরার পথে অঞ্জলিকে ইশারায় ডাকলাম। ডাক শুনে সে যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। কী জানি কিসের কারণে আমিও অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। যে মেয়ে প্রতিদিন আমাকে দেখার জন্য উঁকিঝুঁকি দেয়, সেই কিনা এভাবে আড়ষ্ট হবে, বুঝতে পারিনি।
তারপরও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল। চোখ দুটো মাটির দিকে। বুঝলাম, লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। একটু হালকা করার জন্য বললাম, ‘তোমার ফুলগুলো সুন্দর। কোথা থেকে তুললে? ’
লজ্জায় এমন হলো যে মুখ থেকে কোনো কথাই বের হলো না। তবে চোখের ভাষা ছিল অন‍্য রকম। সেখানে অনেক কিছু ফুটে উঠেছিল।

আমি বুঝতে পেরে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকালাম। গভীর মায়া। আমার কাছে আসামাত্রই দুটো জবা ফুল হাতে দিয়ে চলে যেতে উদ‍্যত হলো। আমিও কিছু বললাম না। শুধু মাথাটা কাত করলাম।
ও চলে গেল। আমি ওর চলে যাওয়া দেখলাম।

জবা ফুল আমার অনেক পছন্দের। রক্তের মতো রং। যদিও গন্ধ নেই, তবু এর গঠনশৈলী আমাকে মোহিত করে। এ কারণেই হয়তো একসময় জবা ফুল নিয়ে কিছু ছড়া–কবিতা লিখেছিলাম।

পরদিনও অঞ্জলি এল। ফুল তুলে ফেরার পথে ডাকলাম। আজ যেন লজ্জা অনেকটাই কমে গেছে।
বেশ স্বাভাবিকভাবে কাছে এসে দাঁড়াল। চোখের ইশারায় ডাকার কারণ জানতে চাইল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি প্রতিদিন ফুল দিয়ে কী করো?’
এ ধরনের প্রশ্ন ও যেন আশাই করেনি। কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। তাল সামলে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় আমিই বললাম, ‘যাদের বাগান থেকে ফুল তুললে, ওরা কিছু বলল না?’
প্রতিউত্তরে ও শুধু মাথাটা দুদিকে দোলাল।
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আজও দুটো ফুল দিল। তারপর কিছুক্ষণ চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। আমিও আর কিছু বলতে পারলাম না। ও চলে গেল।

আরও পড়ুন

প্রীতিশ বাবু অনেক দিন ধরেই বদলির চেষ্টা করছিলেন। পারিবারিক কারণে তাঁর কুষ্টিয়ায় থাকা দরকার। ইচ্ছাটা পূরণ হলো। বদলির আদেশ হাতে পেলেন।
প্রীতিশ বাবুর বদলির কথা শুনে কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে গেল। এক অকৃত্রিম বন্ধুর বিচ্ছেদের কথা ভাবতেই মনের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। তাঁকে সেটা বুঝতে দিলাম না। যদি ভাবেন, তাঁর সুবিধার কথা শুনে আমি খুশি হতে পারিনি! তাই বুকের মধ্যে কষ্ট চেপে রেখে হাসিমুখে অভিনন্দন জানালাম।

তাঁর বিদায় উপলক্ষে কলেজে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। অনেকেই বক্তৃতা দিলেন। আমিও দিলাম। তাঁর অকৃত্রিম সাহচর্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানালাম।

রাতের বেলা হোস্টেলের ছাদে বসলাম। আজ আর তেমন কথা হলো না। তবু একবার সেই গানটা গেয়ে শোনালেন। কিন্তু গল্পটা আর শেষ হলো না।

যাওয়ার সময় অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। আমিও রাজি হলাম। কথা দিলাম।

প্রীতিশ বাবু ইচ্ছা করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। অঞ্জলির বেলায় তেমনটি ঘটেনি। অথচ দুটো বিদায়ই আমাকে ব‍্যথাতুর করে দিল।

মনে পড়ে, ফেলে আসা সেসব দিনের কথা। প্রতিদিন ভোরে আমাকে দেখতে না পেলে অঞ্জলি কেমন অস্থির হয়ে যেত। ফুল তুলতে যাবার সময় দেখা না পেলে ফেরার সময় ঠিক দাঁড়িয়ে থাকত। আমার সঙ্গে দেখা করে কিছু ফুল দিয়ে তারপর যেত। ওর সঙ্গে কথা যে প্রতিদিন হতো, তা নয়। কোনো দিন দুই-একটা হতো, কোনো দিন হতোই না। চোখের ইশারায়ই কেটে যেত। তবে আমার জন্যই যে সে ফুল তুলতে আসত, সেটা বুঝতাম।

অঞ্জলিকে ভোরবেলায় দেখতে না পেলে আমারও ভালো লাগত না। একবারের জন্যে হলেও দেখার তীব্র বাসনা মনে ঝড় তুলত। অঞ্জলিকে খুব পছন্দ করতাম। ওর নিষ্পাপ মুখ। মায়াভরা চোখ। মন উজাড় করা ভালোবাসা। সবকিছু মিলে স্নিগ্ধ ভোরের মতো স্নিগ্ধতা দোলা দিয়ে যেত।

বিধাতা বুঝি মানুষের ভালো লাগাকে বেশিদিন স্থায়ী করেন না। অঞ্জলির প্রতি যখন প্রচণ্ড ভালো লাগা তৈরি হলো, তখনই বিদায়ের সুর বেজে উঠল। একদিন সকালে ফুল তুলতে এসে সে বলল, ‘আমার আর ফুল তুলতে আসা হবে না।’
: কেন?
ছলছল চোখে বলল, ‘আগামী মাসের সাত তারিখে এ গ্রাম ছেড়ে চলে যাব আমরা। বাবার ব‍্যবসা ভালো যাচ্ছে না। তাই মা–বাবা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আপাতত পদ্মাপাড়ে মামাবাড়িতে যাব। ওখানে মামাদের সঙ্গে বাবা ব‍্যবসা করবেন।’
এটুকু বলতেই বাঁধ ভাঙা জলের মতো তার কান্না উপচে পড়ল। কথা বলার শক্তি হারিয়ে গেল। তবে একটা কথা বারবার প্রতিধ্বনিত হলো, ‘যেখানেই যাই, যেভাবেই থাকি, আপনার জন্য প্রতিদিন ফুল তুলব। মালা গাঁথব।’

অনেক কাল পেরিয়ে গেছে। সেদিন বিকেলে কলেজে ক্লাস ছিল। ক্লাস শেষ করে অধ‍্যক্ষ মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। গ্রাম থেকে খবর এল, ভারত থেকে আমার এক বাল‍্যবন্ধু এসেছে। আগামীকালই চলে যাবে।

বাড়ির পথে রওনা দিলাম। হাবাসপুর নৌকাঘাটে এসে রাত হয়ে গেল। আবহাওয়া খারাপ। মাঝি নৌকা ছাড়তে রাজি হলো না। অগত‍্যা প্রীতিশ বাবুর বাড়িতে গেলাম রাতযাপনের জন্য।

ভাগ্য অনেকটা সুপ্রসন্ন ছিল। প্রীতিশ বাবুও সেদিন বিকেলেই বাড়িতে এসেছেন। বেশ কিছুদিন পরে তাঁকে পেয়ে ভালো লাগল। অনেক রাত অব্দি গল্প হলো। সেই গল্পটা শেষ করার অনুরোধ করলাম। কেন জানি আজও তিনি এড়িয়ে গেলেন।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে প্রীতিশ বাবুদের বাগানের দিকে গেলাম। দূর থেকে মনে হলো, কেউ একজন ঘোমটা মাথায় ফুল তুলছে। এগিয়ে গেলাম। বাতাসের ঝাপটায় মাথা থেকে ঘোমটা সরে গেল। মুখের ওপর নজর পড়তেই চমকে উঠলাম।
অঞ্জলি!