বলো, কোন প্রিয় নামে ডাকি (তৃতীয় পর্ব)

ছবি: এআই/বন্ধুসভা
হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে কারও বুকে গিয়ে আছড়ে পড়লাম বলে মনে হলো। ঘোর কাটতে না কাটতেই আমার মুখটা হাত দিয়ে উঁচু করে ধরল সে।

প্রায় ৩২ ঘণ্টা হতে চলল আপনি নেই। এই শূন্যতা কাউকে ব্যাখ্যা করার মতো না। কিছু জিনিসের ব্যাখ্যা করা যায় না, বোঝানো যায় না। এই ব্যাপারটাও তেমন। আমাদের এই অপেক্ষাগুলো রেলগাড়ির মতোন। স্টেশনে স্টেশনে থামে। কোন স্টেশন জানি না। আজীবনের জন্য আদৌ থামবে কি না, তার ঠিক নেই। হয়তো থামবে না। সবার জীবন তেঁতুলবনে জোছনার শেষটার মতোন সুন্দর হবে, এমন কোনো নিয়ম নেই।

সাড়ে এগারোটা বাজল বলে। রুমি হয়তো আমার জন্যই বলেছিলেন, ‘আই ক্লোজড মাই মাউথ অ্যান্ড স্পোক টু ইউ ইন আ হানড্রেড সাইলেন্ট ওয়েস।’
অনেক কথা হলো আমাদের মধ্যে। কালকের চেয়ে মন আর শরীর দুটোই কিছুটা ভালো এখন। আমাদের কথোপকথন কিছুটা এমন—
মি. ইয়ে?
হুঁ।
কী করছেন?
বসে আপনাকে ভাবছি।
সত্যি ভাবছেন, নাকি মিথ্যা বলছেন?
মিথ্যা বলছি না।
আপনার মন ভালো?
মোটামুটি।
কেমন আছেন?
ভালোই। আপনি?
ভালো নেই।
কেন?
বলতে ইচ্ছে করছে না।
আমাকে মিস করেন?
আপনি কবে আসবেন?
এই তো শিগগিরই।
খেয়েছেন?
হ্যাঁ, আপনি?
না, খাইনি।
খেয়ে নিন। রাত হয়েছে।
হুম। হি হি!
হাসছেন যে!
আনন্দ হচ্ছে।
কেন?
আনন্দ হচ্ছে এই ভেবে যে আমি কেবল একা আমাদের আলাপ মিস করি না, আপনিও করেন। নিয়ম মেনে রাতে আমার সঙ্গে কথা বলতে আসেন। হি হি হি!

আরও পড়ুন

আমারও খুব ভালো লাগছে, রিপোর্শিয়া।
আপনি আমায় নাম ধরে ডাকলে আমার ভালো লাগে, মি. ইয়ে।
কী করছেন?
বসে বসে আকাশ দেখছি আর কথা বলছি।
আকাশের মেঘগুলোর মতো আপনাকে নিয়ে বোহেমিয়ান হয়ে যাব একদিন।
হি হি। খুব ভালো লাগছে আজ। একটা কথা বলি? রাগ করবেন না তো?
রাগের কথা বলবেন বুঝি? শুনি আগে।
না, আগে বলুন, রাগ করবেন না।
আচ্ছা, করব না।
আমি আপনাকে একটু ‘তুমি’ করে ডাকি?
ডাকুন।
তুমি এত গম্ভীর হয়ে থাকো কেন, বলো তো?
জানি না।
তুমি জানো, আমি কেবল চিঠিই লিখি। প্রতিদিন একটি করে মেসেজ পাঠানোর কথা, তা করছি না।
কেন?
কারণ, একটা পাঠিয়ে দেখেছি। এটা করতে লাগলে আমাদের চ্যাট অনেক ওপরে চলে যাবে। এতে আমার বারবার পড়তে অনেক ঝামেলা হবে। তাই সব কথা এখানেই লিখছি।
তা বুঝলাম বেশ।
মন খারাপ করলে?
আরে না। কেন করব?
আচ্ছা।
থামলে যে?
না, কিছু না। ঘুমাবেন কখন?
আরেকটু পর। আপনি?
আমিও ঘুমাব। কিন্তু তার আগে আপনাকে নিয়ে অনেক কিছু লিখব। এরপর ঘুম পেলে ঘুমাব।
তা বেশ। গান শোনেন?
মারাত্মক শোনা হচ্ছে। আচ্ছা, নবনী যদি সত্যি ছেড়ে যেত?
আপনার মনে হয় যেত?
আমার মনে হওয়ায় না–হওয়ায় কিছু যায়–আসে না।
তা–ও ঠিক। আমায় ছাড়া ভালো লাগে?
একদম না। আপনি থাকলে ভালো লাগত।
আপনি একদিন আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, দিনের কোন সময়টা আমার ভালো লাগে, আপনার মনে পড়ে?
হ্যাঁ, পড়ে। আপনি রুমির একটা কোট শুনবেন?
আজ পড়লেন?
হ্যাঁ।
শোনান।
দ্য বিউটি ইউ সি ইন মি ইজ আ রিফ্লেকশন অব ইউ।
চমৎকার!
জানি।
তা হঠাৎ এটা মনে পড়ল?
এমনি। আরেকটা শুনবেন?
হ্যাঁ।
ক্লোজ ইয়োর এজ, ফল ইন লাভ, স্টে দেয়ার।
বাহ! রুমি তো চমৎকার।
হ্যাঁ, আপনার মতোই।
আমি চমৎকার?
হ্যাঁ। কেবল তা–ই নন, আপনি এক দুরারাধ্য প্রাণী।
আপনার এত কঠিন কঠিন কথা বোঝা কষ্টকর।
তাহলে আজ থাক।
চলে যাচ্ছেন?
একদম না। সব সময় আছি।
কী হলো? চুপ কেন?
তুমি নাহয় রহিতে কাছে। কিছুক্ষণ আরও নাহয় রহিতে কাছে। আরও কিছু কথা নাহয় বলিতে মোরে...।

আরও পড়ুন

আমার সবে গুড মর্নিং হলো। ঘড়িতে এখন সময় সাড়ে আটটা। আপনার নিশ্চয়ই অনেক আগেই হয়। আমারও হতো। কিন্তু রাতে ঘুম কম হয়েছে, তাই উঠতে পারিনি। ঘুম ভাঙাটাকে ভয় পাই আজকাল। উঠলেই সেই গলা চেপে ধরা শূন্যতা। কে-ই বা স্মৃতি খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে বলুন? মহীনের ঘোড়াগুলোর কটা লাইন সকাল থেকে মাথায় ঘুর ঘুর করছে—
‘ভালো লাগে ডিঙি নৌকায় চড়ে ভাসতে, প্রজাপতি–বুনোহাঁস ভালো লাগে দেখতে, জানালার কোণে বসে উদাসী বিকেল দেখে, ভালোবাসি একমনে কবিতা পড়তে, তবু কিছুই যেন ভালো যে লাগে না কেন, উদাসী পথের মাঝে মন পড়ে থাকে যেন, কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবু?’

আজ সাতকাহন পড়ছি। রমলা সেন দীপার সঙ্গে আলাপ করছে নিঝুম রাতে। রমলা সেনের কথা শুনে মনে হলো, আমার নিজের ছবি এঁকে দিয়েছেন লেখক। বর ছিল, মনের মিল হয়নি বলে একাই থাকেন। শিক্ষিতা কিন্তু বড্ড খটমটে, স্পষ্টভাষী। আমার পরিচিত এক লোক ছিল। বহু মাস আগে সে আমায় এভাবেই বর্ণনা করে বলেছিল, ‘আপনার কপালে বড্ড দুঃখ আছে।’
কেন দুঃখ আছে, সে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার রুচি হয়নি। বোধ হয় মনের অজানা কোণেই আমার উত্তরটা পেয়ে গিয়েছিলাম। ভয় হয়, আমার একাকিত্ব আরও চেপে বসল যেন। কেমন কেমন উদাস লাগছে!

ভাস্কর চক্রবর্তীর একটা কবিতা পড়লাম—
‘অচেনা পাহাড়ে, আমি নিয়ে যাব তোমাকে একদিন
চুমু না-খেয়ে, খাদের কাছে
তোমায় দাঁড় করিয়ে রাখব—
তুমি [চমকে] উঠলেই, আমি ঠেলে দেব তোমাকে খাদের ভেতর
তুমি লাফ দিতে চাইলেই, ভীষণভাবে
তোমাকে জড়িয়ে ধরব।’

কী অদ্ভুত এক মনস্তত্ত্ব, তা–ই না? কবিতাটা উপলব্ধি করে আমার গা শিউরে উঠল। মানুষের মন কতই না বিচিত্র!

একটা কোট পড়লাম। একঝাঁক দীর্ঘশ্বাস নেমে এল। মনে হলো আমার অপেক্ষা আমার দিকে তাকিয়েই যেন বিদ্রুপ করছে। মাহমুদ দারবিশ লিখেছেন—
‘শি সেইস: হোয়েন আর উই গোয়িং টু মিট?
আই সেইড: আফটার আ ইয়ার অ্যান্ড আ ওয়ার
শি সেইস: হোয়েন ডাজ দ্য ওয়ার এন্ড?
আই সেইড: দ্য টাইম উই মিট’

লোকে লোকারণ্য। সবার তাড়া আছে ফিরে যাওয়ার। কেবল আমি কোথাও ফিরব না।

তিন.
গুনে গুনে প্রহর কাটে আমার। সময় যাচ্ছে না। দস্তয়েভস্কির হোয়াইট নাইট পড়ে মনটা আরও উদাস হয়ে আছে। একাকিত্ব আর হতাশা তিলে তিলে গ্রাস করছে আমায়। মনে হয়, আমার ফেরার জন্য কেউ অপেক্ষায় নেই, কেউ ভাবছে না আমায়। এ যেন এই যান্ত্রিক জীবনের অনিবার্য নিয়তি। কিন্তু এই নিয়তি মানতে আমি নারাজ। এক হাড়–জিরজিরে বৃদ্ধ উঠলেন আমার সঙ্গে বাসে। বিকেলের মৃদু আলোয় তার ভাঁজপড়া কপালে ছবি আঁকছে ডুবতে থাকা সূর্য। মানুষটার হাতে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট বইটি। জানতে ইচ্ছে করল, তার এই দীর্ঘ জীবন কী করে কাটল? বই পড়ে? সে কি জানতে পেরেছে ফিলসফির সেই সব উত্তর? নাকি না জেনেই আট-দশটা মানুষের মতো পারাপারের দিকে অনন্ত যাত্রা তারও?

মন খারাপ বাড়ছে। রেললাইনের পাশ ঘেঁষে হাঁটছি। সাঁই করে চলে গেল একট ট্রেন। সঙ্গে হুইসেল। আলোর তীব্রতায় চোখ বন্ধ হয়ে এল। লোকে লোকারণ্য। সবার তাড়া আছে ফিরে যাওয়ার। কেবল আমি কোথাও ফিরব না। পুরোনো দিনের স্মৃতির মতো উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে কারও বুকে গিয়ে আছড়ে পড়লাম বলে মনে হলো। ঘোর কাটতে না কাটতেই আমার মুখটা হাত দিয়ে উঁচু করে ধরল সে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় এই প্রথম দেখলাম তাকে। এত স্নিগ্ধ!
মনে পড়ল নজরুলের গানের চরণ—
‘যত দেখি তত হয়, পিপাসা বাড়িয়া যায়...’
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘আপনি?’ সে আমার হাত শক্ত করে ধরতে ধরতে বলল, ‘চলুন মিস জীবনানন্দ, আরেকটু হলেই তো যাচ্ছিলেন।’
আমি কপট রাগ দেখানোর ভান করলাম। তাতে সে পরোয়া না করে বলল, ‘তা, আজ এই মনোরম সন্ধ্যায় দু পেয়ালা কফিপানে সম্মত হইলে...’

বাকিটা আমি তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আফটার শেভের তীব্র সুঘ্রাণ। কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, ‘ফর গড সেক, হোল্ড ইয়োর টাং অ্যান্ড লেট মি লাভ!’
(সমাপ্ত)

শিক্ষার্থী, শহিদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।