আর দুই ঘণ্টা পর সাড়ে ১১টা বাজবে। আমাদের টেলিপ্যাথিক আলাপের সময়। পুরো দিনে বোধ করি এই সময়টার জন্যই আমি অপেক্ষা করে থাকি—
দুই.
চিঠির শুরুতে আপনাকে কী বলে সম্বোধন করব বুঝতে পারছি না। প্রিয়? নাকি চলে যাওয়ার অপরাধে অপ্রিয়? জানি না।
৯ ঘণ্টা হতে চলল আপনি নেই। আপনি যে নেই এতগুলো সময় ধরে, আমি উপলব্ধি করতে পারিনি এতক্ষণ। আপনি চলে যাওয়ার পর অনেক কান্না পাচ্ছিল। এই ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়ি। উঠি সন্ধ্যায়। তখন গান শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, কী হয়ে গেল আমার! আপনাকে এত অনুভব করার কি কোনো কথা ছিল! ছিল না সম্ভবত। তবু কষ্ট হচ্ছে। তাই ঘর গোছালাম। ঘর গোছালে মন ভালো থাকে। তবু কষ্ট কমছিল না। কারণ, ফোনে তখন বাজছিল আমাদের সেই গানগুলো।
আজকের আকাশটা এত কালো! একটুও আলো নেই যেন। এত বিষণ্ন কেন আজ সবাই? আপনি কী করছেন? এখন নিশ্চয়ই বসে বসে আমায় ভাবছেন তা–ই না? কারণ, এখন আমাদের কথা বলার সময়। সময় পাইনি এতক্ষণ। তাই চিঠি এখনই শেষ করতে হচ্ছে। কথা বলতে হবে তো এখন, তাই। আমার ভালো লাগছে না আপনাকে ছাড়া। কী জাদু করিলা অচিন মানুষ?
অনেক কথা বাকি রয়ে গেল। অনেক কিছু লুকিয়ে রাখা। এখন আর বলতে পারছি না। আমার কথা বলতে হবে। সাড়ে ১১টা বাজল। আসি। মিস ইউ মি. ইয়ে।
ভীষণ মিস করছি। সারা রাতও করব, আমি জানি। মনটা আকাশের মতোই ভার হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি চলে আসুন আপনি।
অনেক মনে পড়ছে। কাল যে কত কত কথা হলো আমাদের! আপনার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা বারবার ভুলিয়ে দিচ্ছিল কথা। এত কথা বলার পরও শেষই হচ্ছিল না। অথচ দেখুন, আপনি থাকলে কত চেষ্টা করেও কথা খুঁজে পাই না। আজ সকালটা সুন্দর ছিল। তবু বিষণ্ন লাগছে। কান্না পায়। মনে হয় কী যেন নেই। এই শূন্যতা পূরণ হচ্ছে না। হয়তো পূরণ হবে আপনি এলে।
মি. ইয়ে, কেমন আছেন আপনি? এখন নিশ্চয়ই ব্যস্ত। আমায় ভাবার সময়টুকু নেই। আমি কিন্তু এই অগোছালো জীবন থেকে সময় চুরি করে করে আপনার জন্য রেখে দিচ্ছি। আপনি এলে সবটা যেন উজাড় করে দিতে পারি। এই অনিয়মের জন্য নিশ্চয়ই ফল ভোগ করতে হবে। তাতে আমার যায় আসে না। বিষয়টা আমার ভালো লাগে, বিষণ্নতা কমে যায়; তাই করছি। আপনি আর যা-ই করেন না কেন, আকাশ নিশ্চয়ই দেখতে বাধা নেই। আমিও দেখছি আকাশ। একটা মেঘকে সবটা বললাম। ও হয়তো আমায় বুঝল। কেন যেন মনে হলো মেঘটা ভাসতে ভাসতে আপনার কাছে যাবে। আপনাকে বলবে আমার কথা।
নতুন অনেক গান শুনছি। আপনি এলে আবার শুনব দুজন। আর হ্যাঁ, তেঁতুল বনে জোছনা বইটার বিখ্যাত লাইনগুলো আমি বিভিন্ন পোস্টে পড়ে আগে থেকেই কাহিনি জানতাম। কিন্তু কাল আপনি যাওয়ার পর বইটা পড়তে বসলাম এই প্রথম। সাতকাহনটাও পড়ব। নবনীর শাশুড়িও দেখি বইটা পড়ছিল! আচ্ছা, একটা বিষয় ভাবলাম এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে। আপনার নেমপ্লেটে নামের বানান সজিব; কিন্তু সেদিন আপনি যখন ম্যাগাজিনের ছবিটা দিলেন, ওখানে আপনার নামের বানান ছিল সজীব। আমার ধারণা সজিব নামটাই সঠিক, তা–ই না? নেমপ্লেটে সাধারণত ভুল বানান থাকার কথা না। আর শুনুন, আপনি কখন আসবেন? আমার ভালো লাগছে না।
দুই দিনের বিষণ্নতা আর জ্বর মিলে এই ঘূর্ণনশীল পৃথিবীর প্রতি এক অভিমান তৈরি করছে আমার মনে। মানুষ বেশি বিষণ্ন থাকলে বেশি ঘুমায়। আমারও হয়েছে তা। বইটা পড়ছি, ঘুমিয়ে যাচ্ছি। এখন মানুষের মেসেজ বিরক্ত লাগা শুরু করেছে। বিষয়টা ভয়ানক। আগে মেসেজ এলে চেক করতাম আপনি কি না। এখন মেসেঞ্জারে নোটিফিকেশন বন্ধ। মাঝেমধ্যে যাই, আমাদের কথোপকথন পড়ার জন্য। এ অব্দি সেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চারবার পড়া শেষ করেছি। হয়তো আরও পড়া হবে সামনে। ভেবে দেখলাম, আমি অদ্ভুত নই কেবল, চরম উদ্ভটও। চ্যাটে বড্ড ছেলেমানুষি করেছি। আপনি নিশ্চয়ই আমায় বাচ্চা একটা মেয়ে ভাবছেন। আদতে অন্য সবার কাছে আমি কিন্তু তেমন নই। আমি কিছুটা কঠিন–কঠোর গদ্যের মতো তাদের চোখে।
মি. ইয়ে, আজ দুপুরের দিকে হালকা কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি হলো। আপনাকে ভীষণ মনে পড়ছিল তখন। প্রকৃতি রূপ বদলায় মানুষকে অতীত-ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার জন্যই। নাহ, এটা কোথাও লেখা নেই। এটা স্রেফ আমার বিশ্বাস। তেঁতুল বলে জোছনা বইটার ইমাম সাহেব মারা গেছেন। সে অব্দি এসে উপলব্ধি করলাম আমার ভালো লাগছে না কিছু। বলব না আগে ঢের ভালো লাগত, কিন্তু এখন লাগছে না। আগেও লাগত না। কিন্তু এখনকার না লাগাটায় অদ্ভুত এক হাহাকার আছে। যেন কেবল পুরো জগতে আপনিই ছিলেন, এখন স্রেফ আমায় বিস্মিত করে উবে গেলেন কর্পূরের মতো। আমি হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না। এ যেন চরম ব্যর্থতা আমার।
আকাশ দেখছি আর লিখছি। জানালার সামনের পরপর দুটো বিল্ডিং পেরোলেই আকাশছোঁয়া এক বিল্ডিং। ওটার ছাদে কবুতর পোষে কেউ একজন। ওদের দল বেঁধে ওড়াউড়ি দেখেই সময় কাটছে আমার। সামনের বিল্ডিংটার চারতলা অব্দি প্রতিটা জানালায় অজস্র মানুষের কর্যকলাপ দেখি একা একা। একটা মেয়ের বোধ হয় মন খারাপ। তিনতলায় থাকে। গালে হাত দিয়ে কী যেন ভাবে। হঠাৎ একটা কাক উড়ে গেল। এতই দ্রুত যে কিছুক্ষণের জন্য ভেবেছি আপনি বোধ হয় চিঠি দিয়ে কবুতর পাঠালেন! মেয়েটার জানালার সানসেটে বসে কাকটা এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজল। তারপর উড়ে গেল।
নবনী আনিস সাহেবের কাছে এল। সে নেই, নবনী অপেক্ষা করছে। সেই অব্দি পড়লাম। হুমায়ূনের লেখা পড়ে তার আর আনিসের সঙ্গে আপনার দুটো মিল পেলাম। হুমায়ূন খুব সাধারণ একটা কথাকে অসাধারণ ভঙ্গিতে বর্ণনা করতে জানেন। আপনিও তা পারেন। আর আনিস বড্ড গম্ভীর মানুষ। আবেগ রয়েছে, কিন্তু আবেগের প্রকাশ নেই। এসব পড়ে মনে হলো হুমায়ূন বোধ করি টাইম ট্রাভেল করে এই সময়ে এসে আপনার বৈশিষ্ট্যগুলো জেনে নিয়ে আনিসের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। আপনি কী করছেন মি. ইয়ে?
আচ্ছা শুনুন, আনিস গিয়েছিল মিঠাপুকুর। বিরাটনগর থেকে মিঠাপুরের দূরত্ব ৭ মাইল, যা হুমায়ূন আহমেদের ভাষ্যমতে দুই ক্রোশের সামান্য বেশি। আমি জানি এক ক্রোশ প্রায় ২ মাইলের কাছাকাছি। তবে দুই ক্রোশ কী করে সাত মাইলের কাছাকাছি হয়? এখানে লেখক ভুল করল, না আমি? কে জানে!
এই মাত্র বইটা শেষ করে উঠলাম। এখন রাত নয়টা। বইটা পড়ে কী যে আনন্দ হলো! ডাক্তার সাহেবের মতো আমিও কাঁদছি। এই কান্না দুঃখের কান্না না। আরেকটু মন উজাড় করে কাঁদতে পারলে ভালো হতো। পারছি না। উজাড় করে কাঁদার জন্য একটা বুক প্রয়োজন। প্রয়োজন একটু সহানুভূতির, যা আপাতত আমার নেই। থাকলে বুকটায় আছড়ে পড়ে কেঁদে একটু হালকা হতাম।
আর দুই ঘণ্টা পর সাড়ে ১১টা বাজবে। আমাদের টেলিপ্যাথিক আলাপের সময়। পুরো দিনে বোধ করি এই সময়টার জন্যই আমি অপেক্ষা করে থাকি—কখন রাত সাড়ে ১১টা বাজবে। ঘড়ির টিকটক নিয়ম মেনে আপনার জীবন কাটলেও আমার কোনো দিন কাটেনি। এখন কাটছে, অথচ বিরক্ত হচ্ছি না। যেন নিয়ম মানাতেই এই জন্মের সার্থকতা। মাঝেমধ্যে ভাবতাম, আমার বোধ হয় বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই। আমার জন্য কেউ লেখে না। আমি কারও অপেক্ষায় নেই, আমার জীবনে কিছুই নেই। অথচ আজ উপলব্ধি করলাম আমি ভুল। প্রতিদিন রাত অব্দি অযাচিত সব আলাপের জন্য হলেও জনম জনম বাঁচতে চাই। আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন সে অব্দি? না হলে আমার এত শত আয়োজন, চোখের জল—সবই যে বৃথা হয়ে যাবে।
(চলবে...)
শিক্ষার্থী, শহীদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।