বলো, কোন প্রিয় নামে ডাকি (প্রথম পর্ব)

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

এক.
জুন মাসের একঘেয়ে বিষণ্নতা নিয়ে সেদিন একটু ভালো বোধ হলো। বিছানা ছেড়ে এই ঘূর্ণনশীল জগতের প্রতি একবুক অভিমান নিয়ে উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম জানালার পাশে। আকাশ স্বচ্ছ, নির্মল। মনে হচ্ছিল কোনো পটু হাতের শিল্পী রংতুলি দিয়ে ভীষণ যত্নে ছবি এঁকে রেখেছে। দূরে কিছু পায়রা উড়ছে। এই মৃতপ্রায় বিকেলে সর্বপ্রথম আমি তার অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে আরম্ভ করলাম। চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে না পড়তেই আনমনে গাইলাম—
‘আই টেক মাই হুইস্কি নিট
মাই কফি ব্ল্যাক অ্যান্ড মাই বেড অ্যাট থ্রি
ইউ আর টু সুইট ফর মি
ইউ আর টু সুইট ফর মি’

যে প্রথম শুনিয়েছিলেন গানটা, তাঁর জন্যই এই হাহাকার, বিষণ্নতা। আমাদের পরিচয়টা খানিক বিচিত্র। যখন ভাবতে বসি, কল্পনায় যেন এক অপূর্ব স্বপ্ন তৈরি হয়। কাউকে নিয়ে স্বর্গীয় গানের মতো সুন্দর কল্পনা করা যায়, আগে বুঝিনি।

অল্প অল্প করে কথা বাড়ছিল। গল্প, গান আর মন খারাপের কবিতা নিয়ে বেশ আলাপ হলো। একদিন তিনি বললেন,

সচরাচর মেসেজিং করা হয় না। জীবনে এতবার উত্থান-পতনের সম্মুখীন হয়েছি যে মানুষ দেখলেই ঘাবড়ে যাই। কিন্তু সেদিন কী যেন হলো আমার! একটি ফেসবুক আইডি থেকে মেসেজ এল। খানিকটা অবহেলায় ফেলে রাখলাম কিছুক্ষণ। তারপর শুরু হলো আলাপ। কথায় কথায় জানলাম, আমার লেখা তাঁর ভালো লাগে। আরও কত কী! এসব কথায় কোনো আগ্রহ পেলাম না। প্রায়ই মানুষ মেসেজে এসব বলে। ভেতর ভেতর অস্বস্তি হয়। কেন যেন মনে হয়, কী এমন হাতি-ঘোড়া লিখি কে জানে!

আমার মনের কথা তিনি পড়তে পেরেছিলেন বোধ হয়। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাফকার লেখা পড়া হয়?’
উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, সদ্য তাঁর লেখা পড়ছি।’
‘তিনি মৃত্যুর সময় তাঁর বন্ধুকে কী বলে গিয়েছিলেন, জানেন?’
‘না, কী বলেছিলেন?’
‘তিনি বলেছিলেন, তাঁর লেখা যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। কারণ, নিজের লেখা তাঁর পছন্দ হতো না। কিন্তু তাঁর বন্ধু সে কথা রাখেননি। এ জন্যই তিনি অমর হয়ে আছেন।’
আমি অস্বস্তির একটা ইমোজি পাঠালাম মেসেঞ্জারে।
তিনি লিখলেন, ‘কোনো কিছু লিখলে আমায় দেবেন। আমি পড়ব।’

ভীষণ ব্যস্ততায় দিন কাটছিল। কলেজ, প্র্যাকটিক্যাল, আসা-যাওয়া। এক ছুটির সন্ধ্যায় আবার তাঁর মেসেজ—
‘গান শোনেন?’
‘মারাত্মক শুনি।’
এরপর দেখি ‘ব্লু’ গানটা পাঠিয়েছেন। গানটা আমার এমনিতেও ভীষণ প্রিয়। আরও ভালো লাগছিল, যখন ভাবলাম, কেউ আমার জন্য এমন একটা গান পাঠিয়েছে। গুনে গুনে বেশ কয়েকবার শুনলাম।

অল্প অল্প করে কথা বাড়ছিল। গল্প, গান আর মন খারাপের কবিতা নিয়ে বেশ আলাপ হলো। একদিন তিনি বললেন, ‘দেখবেন “তেঁতুলবনে জোছনা” বইটার মতো আপনার জীবনটাও সুন্দর হবে।’
এই কথায়ই যেন তাল কেটে গেল। চশমার ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায় কান্না। যেন নিয়তি আমার জানা। এই দমবন্ধ জগতে আমার বাঁচার যে কোনো মানে নেই, সেটা হঠাৎ তাঁর কথা শুনে মনে পড়ে গেল।
নিজেকে সামলে মেসেজে লিখলাম, ‘হয়তো।’
তিনি বললেন, ‘হয়তো না। দেখবেন, সত্যি হবে।’

ঠিক হলো, দুজন দুজনের জন্য চিঠি জমাব। একদিন সুযোগ করে কবুতর দিয়ে সব চিঠি পাঠিয়ে দেবেন আমার জন্য।

আমার বদ্ধ ঘরে আলো জ্বালা হয় সন্ধ্যা বাড়লে। বাইরে চাঁদের আলো, ভেতরে গুমোট বাতাস। খোলা জানালা দিয়েও যেন বাতাস আসে না। বাইরে ল্যাম্পপোস্টের অযাচিত অত্যাচার। আর ফোনের নীলাভ আলোয় অদ্ভুত এক আলেয়া। একটু একটু করে মুগ্ধ হচ্ছি। খুব সাধারণ, অথচ সবচেয়ে অসাধারণ!
আমার বছরখানেক আগের একটা ছবি পাঠিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনার সঙ্গে দীপাবলির কিন্তু মিল আছে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন বলুন তো?’
তিনি উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘ফর গড সেক, হোল্ড ইয়োর টাং অ্যান্ড লেট মি...’
বাকিটা বলতে দিলাম না। মাঝপথে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা, কোথায় থাকেন মহাশয়?’
তিনি বললেন, ‘দূরে। আপনার শহর থেকে অনেক দূরে।’

সেই দূরত্ব আর মাপা হয়নি। তার আগেই তিনি ডুব দিলেন।
ফিরলেন এক ঈদে। হঠাৎ হঠাৎ নির্জীব মেসেঞ্জারে তাঁর মেসেজ পেতে ভালো লাগত। সেবার রাত জেগে বহুক্ষণ কথা হলো আমাদের। বেশির ভাগই গুরুগম্ভীর আলোচনা। এই যেমন ভালোবাসা থেকে অনুভব কেন শক্তিশালী? কেন লর্ড ক্লাইভ আত্মহত্যা করেছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

ধীরে ধীরে অনুভব করতে শুরু করলাম, আমি সারাটা সময় তাঁর মেসেজের অপেক্ষা করি অজান্তেই। হঠাৎ টুং শব্দে ফোনটা নিয়ে তাঁর মেসেজ পেলেই মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। নিজেকে যে খানিকটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করিনি তা নয়, লাভ হয়নি। তিনি ভীষণ গম্ভীর আর এত স্নিগ্ধ যে নীলাভ স্ক্রিনে তিনটা ডটের নাচানাচির মতন তাঁর জন্য অপেক্ষা করার জন্যই প্রস্তুত হয়ে থাকতাম সব সময়। তিনি আসতেন, আমি চাতকের মতো তাকিয়ে থাকতাম। যেমন সামান্য স্পর্শে গিটারের টান টান তারগুলোয় অদ্ভুত সুর জাগে, তেমন করেই বাজতাম আমি। ধীরে ধীরে সময় ফুরাল। তাঁর কলেজে চলে যেতে হবে। যোগাযোগের কোনো উপায় রইল না। সেদিন মন খারাপ করে জানতে চাইলাম, ‘কবে ফিরবেন?’
‘যেদিন কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবেন।’
‘কিডন্যাপ করলে মন খারাপ হবে না?’
‘নাহ, বরং ভালোই হবে।’
তারপর ঠিক হলো, দুজন দুজনের জন্য চিঠি জমাব। একদিন সুযোগ করে কবুতর দিয়ে সব চিঠি পাঠিয়ে দেবেন আমার জন্য। রাত সাড়ে এগারোটায় হবে টেলিপ্যাথিক আলাপ।

তিনি চলে যাচ্ছেন। আমি অঝোরে কাঁদছি। কিন্তু ঢের টের পাচ্ছিলাম, আমার মেসেজগুলোয় আবেগ প্রকাশ পাচ্ছে। নিজেকে শেষবেলায় আটকে রাখতে পারলাম না। বললাম, ‘তাড়াতাড়ি ফিরুন। আমি অপেক্ষা করব। এই অপেক্ষা যেন প্রতীক্ষায় রূপ না নেয়।’
তিনি লিখলেন, ‘নেবে না। শিগগিরই ফিরব।’ (চলবে....)

শিক্ষার্থী, শহিদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।