অন্যান্য শিল্পের মতো মূকাভিনয়কেও মানুষ সমান গুরুত্ব দেবে

বাংলাদেশের মূকাভিনয় জগতে এক আলোচিত নাম রিফাত ইসলাম। নীরব অভিব্যক্তির সৌন্দর্য দিয়ে জয় করেছেন দর্শকের মন, ছুঁয়েছেন শিল্পের নতুন দিগন্ত। প্রথম আলো বন্ধুসভা থেকে যাত্রা শুরু করে আজ তাঁর পদচিহ্ন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বমঞ্চে। দেশ-বিদেশের নানা উৎসব ও প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে রিফাত মুগ্ধ করছেন অসংখ্য দর্শককে। তাঁর এই গল্প অনুপ্রেরণার। তিনি প্রমাণ করেছেন, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা থাকলে যেকোনো স্বপ্নই ছুঁয়ে দেখা যায়। এই যাত্রা, সাফল্য, অভিজ্ঞতা আর স্বপ্ন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন গাজীপুর বন্ধুসভার বন্ধু তানভীর হাসান

সিউল ওয়ার্ল্ড আর্ট ফেয়ার ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ করে স্বীকৃতি পান রিফাত ইসলামছবি: সংগৃহীত

বন্ধুসভা: আপনার শৈশব কেটেছে কিশোরগঞ্জ শহরের প্রান্তবর্তী যশোদল এলাকায়। ছোটবেলার কোন স্মৃতি এখনো মনে পড়ে, যা আপনার শিল্পী হয়ে ওঠার বীজ বপন করেছিল?

রিফাত ইসলাম: অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় নাচের প্রতি ভালো লাগা জন্ম নেয়। সিডি-ক্যাসেটের যুগ ছিল। ৩০ টাকা দিয়ে ১২টি গানের ভিডিও ক্যাসেট কিনে আনতাম। নতুন গান বের হলেই নিজে নিজেই নাচ তৈরি করে এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করতাম। মূকাভিনয়ের সঙ্গে নাচের একটা গভীর সম্পর্ক থাকায়, সেই সময়ে মনে মূকাভিনয়ের বীজ গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। যা পরে বুঝতে পেরেছি, এটাই ছিল আমার শিল্পী হওয়ার পথচলার মূল ভিত্তি।

বন্ধুসভা: প্রথম কবে অনুভব করেছিলেন যে আপনি অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা কিছু ভাবছেন বা অনুভব করছেন?

রিফাত ইসলাম: ২০০৯ সালে কিশোরগঞ্জের উল্লাস নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে জেলা শহরে আমার নাচের যাত্রা শুরু। দুই বছর নাচের অভিজ্ঞতার পর বুঝতে পারলাম, আমাকে শুধু নাচেই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না; সামাজিক অসংগতি ও সমস্যাগুলো নাচের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। এরপর ইউটিউব থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে নাচের সঙ্গে অভিনয় যোগ করে একটি নতুন ধরনের শিল্প সৃষ্টি করলাম। ২০১১ সালে জলছবি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে কাজ শুরু করার পর, সেই সংগঠনের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে আমার নতুন ধারার শিল্প মঞ্চায়ন শুরু হয়। তখন থেকেই স্পষ্ট অনুভব করি যে আমি অন্যদের থেকে একটু ভিন্ন, নতুন কিছু করে যাচ্ছি।

আরও পড়ুন

বন্ধুসভা: মূকাভিনয়ের প্রতি প্রথম আকর্ষণ কীভাবে তৈরি হলো?

রিফাত ইসলাম: আমি যে মূকাভিনয় করছি বা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি, সেটা জানতাম না। ব্যাপারটি খুব ইন্টারেস্টিং। ২০১১ সাল থেকে নাচ ও অভিনয়ের সমন্বয়ে বিভিন্ন পারফর্ম শুরু করি। মূলত ইউটিউব দেখেই বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করতে থাকি। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালে গাজীপুরে অনুষ্ঠিত প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুসমাবেশে পরিচয় হয় মূকাভিনেতা মীর লোকমানের সঙ্গে। সেদিন তাঁর মূকাভিনয় দেখে আবিষ্কার করলাম, আমি যেই শিল্পের চর্চা করে আসছি, সেটাকে মূকাভিনয় বলে। একটা কথা আছে না, ‘চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি’, ঠিক তেমনি নাচ শিখতে গিয়ে মূকাভিনয় শিখে ফেলেছি।

বন্ধুসভা: অনেকেই মূকাভিনয়কে মূলধারার শিল্প রূপ হিসেবে বিবেচনা করেন না। এই বাধা বা ধারণাগুলো কীভাবে অতিক্রম করেছেন?

রিফাত ইসলাম: যুগের পর যুগ অনেক দেশে মূকাভিনয় চর্চিত হয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো পুরোপুরি মূকাভিনয়ের পরিচিতি ঘটেনি। তাই এ শিল্পকে হয়তো অনেকে মূল ধারার শিল্প হিসেবে বিবেচনা করেন না। কিন্তু বর্তমানে চর্চা বাড়ছে। সারা দেশে এই শিল্পের চর্চা ছড়িয়ে পড়ছে। আশা করি আগামীতে অন্যান্য শিল্পের মতো মূকাভিনয়কেও মানুষ সমান গুরুত্ব দেবে।

রিফাত ইসলাম।

বন্ধুসভা: কিশোরগঞ্জের মতো মফস্বল শহর থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে উঠে আসা একটি চ্যালেঞ্জ। সেই যাত্রাটা কেমন ছিল?

রিফাত ইসলাম: গত ১৩ জুন দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মূকাভিনয় উৎসবে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছি। কিশোরগঞ্জের মতো ছোট মফস্বল শহর থেকে এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছানো মোটেই সহজ ছিল না। এই অর্জনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ১৫ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম, ধৈর্য ও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা। পরিবারের পাশাপাশি এই দীর্ঘ যাত্রায় বন্ধুসভার অবদান অনস্বীকার্য। বন্ধুসভা আমাকে মূকাভিনেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

বন্ধুসভা: বাংলাদেশের বাইরে প্রথম কোথায় মঞ্চস্থ করেছিলেন? সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

রিফাত ইসলাম: দেশের বাইরে প্রথম মূকাভিনয় করেছিলাম ভারতের ত্রিপুরায়। ২০১৯ সালে একটি আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রথমবার দেশের বাইরে পারফর্ম করার সুযোগ পাই। এটি আমার জন্য স্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল। স্থান, পরিবেশ ও দর্শকদের প্রতিক্রিয়া, সবকিছুই নতুন। ত্রিপুরার মঞ্চে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছিলাম শিল্পের ভাষা সব দেশের মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। এই অভিজ্ঞতা আমাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং শিল্পী হিসেবে নিজেকে বিকাশের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

আরও পড়ুন

বন্ধুসভা: মূকাভিনয় আপনার কাছে কীভাবে একটি জীবনদর্শন বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করে?

রিফাত ইসলাম: মূকাভিনয় হলো নির্বাক। অনেক সময় কথা বলে অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারি না, তা মূকাভিনয়ের মাধ্যমে সহজেই প্রকাশ করা যায়। অন্যান্য শিল্পের তুলনায় মূকাভিনয় দিয়ে সহজেই আরও জোরালোভাবে সমাজের অসংগতি তুলে ধরা যায়। সমাজের যেই অসংগতি মানুষ মুখে বলে প্রকাশ করতে পারে না, তা মূকাভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করতে চাই। শিল্পী হিসেবে এটা দায়িত্ব।

বন্ধুসভা: সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া থেকে মূকাভিনয় করে এলেন। কোরিয়ান দর্শক ও সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

রিফাত ইসলাম: কোরিয়ায় আন্তর্জাতিক মূকাভিনয় উৎসবে মোট তিনটি পারফরম্যান্স করি। সেই অনুষ্ঠানে কোরিয়ান দর্শক, শিল্পীসহ বিভিন্ন দেশের শিল্পীরা উপস্থিত ছিলেন। আমার পরিবেশনা দেখে সবাই মুগ্ধ হয়েছেন। বিশেষ করে আয়োজকরা খুবই প্রশংসা করে আমাকে আগামী আয়োজনে পুনরায় আমন্ত্রণ জানান, যা বিশাল সম্মানের।

দেশ-বিদেশে নিজেদের সংস্কৃতি, সমাজের নানা অসংগতি ও না–বলা কথা তুলে ধরতে চান রিফাত ইসলাম
ছবি: রিফাত ইসলামের সৌজন্যে

বন্ধুসভা: মূকাভিনয়ে আগ্রহী তরুণদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে?

রিফাত ইসলাম: কেউ যদি মূকাভিনয় করতে চান, প্রথমেই তাঁর উচিত সমাজ, পৃথিবী ও সৃষ্টিকে গভীরভাবে ভাবা। কারণ, মূকাভিনয়ের মূল ভিত্তিই হলো ভাবনা। চারপাশে কী ঘটছে তা লক্ষ করে তার ওপর চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু মূকাভিনয় একটি শারীরিক ভাষা, তাই শরীরকে প্রস্তুত করা জরুরি। পেশিগুলোকে নমনীয় ও ফ্লেক্সিবল করার জন্য নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে এবং ছোট ছোট ভাবনাকে মঞ্চায়নের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হবে। এই ধারাবাহিক চর্চা ও মনোযোগ দিয়ে যে কেউ মূকাভিনয়ের দক্ষ শিল্পী হিসেবে গড়ে উঠতে পারেন।

বন্ধুসভা: আগামী পাঁচ বছরে নিজেকে এবং মূকাভিনয়কে কোন অবস্থানে দেখতে চান?

রিফাত ইসলাম: মূকাভিনয়ের পথেই অবিরত চলতে চাই। শুধু আগামী পাঁচ বছর নয়, আল্লাহ চাইলে আজীবন দেশ এবং দেশের বাইরে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও মানুষের অজানা কথা আর না বলা কাহিনি তুলে ধরতে চাই। এই শিল্পের মাধ্যমেই সমাজের নানা অসংগতি উন্মোচন করে মানুষের মনের ভাষা প্রকাশ করতে চাই এবং মূকাভিনয়কে বাংলাদেশের একটি মর্যাদাপূর্ণ ও স্বীকৃত শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।

বন্ধুসভা: মূকাভিনয়ের পাশাপাশি আর কী কী শিল্পমাধ্যম নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা?

রিফাত ইসলাম: মূকাভিনয়ের পাশাপাশি টেলিভিশন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবেও কাজ করছি। আগামীতেও ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করে যেতে চাই।

বন্ধুসভা: বাংলাদেশে মূকাভিনয় চর্চার প্রসার ও বিকাশে আপনি কী ধরনের ভূমিকা রাখতে চান?

রিফাত ইসলাম: আমি আজীবন মূকাভিনয় করতে চাই। একজন শিল্পী হিসেবে এটা আমার প্রধান দায়িত্ব ও অঙ্গীকার। শুধু নিজে মঞ্চে পারফর্ম করাই লক্ষ্য নয়, বরং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মূকাভিনয়কে একটা ভালো ও শক্তিশালী শিল্প হিসেবে গড়ে তোলা সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। একটি মূকাভিনয় স্কুল খুলতে চাই, যেখানে তরুণরা শুধু কৌশল শিখবে না, তাদের মধ্যে শিল্পের প্রতি ভালোবাসা, দৃষ্টি ও দায়িত্ববোধও তৈরি হবে।