আপনার কাছে যেটা ব্যর্থতা, সেটা অনেকের কাছে সাফল্য

ব্রিটিশ লেখক জে কে রাওলিং। হ্যারি পটার সিরিজ দিয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা আর সাফল্য—দুটোই পেয়েছেন তিনি। ২০১১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেই বক্তৃতার নির্বাচিত অংশ বন্ধুসভার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

জে কে রোলিং
আমাদের এই পৃথিবী বদলাতে জাদুর দরকার নেই। আমাদের ভেতরেই রয়েছে সেই শক্তি—কল্পনা করার ক্ষমতা। এই কল্পনার শক্তি দিয়ে আমরা আরও ভালো ভবিষ্যৎ ভাবতে পারি, গড়তে পারি।

আজকের এই দিনে, আপনাদের সামনে দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলব—ব্যর্থতার উপকারিতা এবং কল্পনার গুরুত্ব।

২১ বছর আগে, আমি যেমন ছিলাম, পেছনে ফিরে তাকালে একটু অস্বস্তি লাগে। সে সময় নিজের স্বপ্ন আর পরিবারের প্রত্যাশার মধ্যে দোটানায় ছিলাম। আমি সব সময় লেখক হতে চেয়েছি। আমার মা-বাবা দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছেন। তাঁরা মনে করতেন, লেখালেখি দিয়ে কখনো সংসার চলবে না। তাঁরা চাইতেন আমি যেন ‘কাজে লাগার মতো’ কিছু পড়ি।

আমি বাবা-মাকে দোষ দিচ্ছি না। একটা সময় আসে, যখন নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হয়। মা-বাবা কখনো চাননি দারিদ্র্যের মধ্যে থাকি। আমি তাঁদের সঙ্গে একমত—দারিদ্র্য কোনো মহান অভিজ্ঞতা নয়। এটা মানসিক চাপ, লজ্জা আর সীমাবদ্ধতার জায়গা। নিজের পরিশ্রমে সেখান থেকে উঠে আসা গর্বের বিষয়, কিন্তু দারিদ্র্যকে রোমান্টিকভাবে দেখা উচিত নয়। আমি দারিদ্র্যের চেয়ে ব্যর্থতাকেই বেশি ভয় পেতাম। যদিও আমি ক্লাসে তেমন ভালো ছিলাম না, কিন্তু পরীক্ষায় ভালো করতাম। বহু বছর ধরে সেটাকেই সাফল্যের মানদণ্ড মনে করা হয়েছিল।

শুধু প্রতিভা আর বুদ্ধি থাকলেই কারও জীবন সহজ হয় না। অনেকেই এখানে হয়তো নানা কষ্টের ভেতর দিয়ে এসেছেন। তবে আপনারা যেহেতু হার্ভার্ড থেকে গ্র্যাজুয়েট—ব্যর্থতা আপনাদের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। হয়তো আপনি সাফল্যের মতোই ব্যর্থতাকে ভয় পান। এমনও হতে পারে, আপনার কাছে যেটা ব্যর্থতা, সেটা অনেক সাধারণ মানুষের কাছে সাফল্য!

আমাদের প্রত্যেককেই ঠিক করতে হবে, কীভাবে ব্যর্থতা পরিমাপ করব। তবে সমাজ সব সময়ই নিজের নিয়ম চাপিয়ে দিতে চাইবে।

গ্র্যাজুয়েশনের সাত বছর পর সব দিক থেকে আমি ‘ব্যর্থ’ ছিলাম। বিবাহবিচ্ছেদ, চাকরি ছিল না, সিঙ্গেল মা, প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় ছিলাম। আমাকে নিয়ে বাবা-মায়ের যেসব শঙ্কা ছিল, সবই সত্যি হয়েছিল। নিজেকে বড় ব্যর্থ মনে করতাম। সে সময়টা জীবনের অন্ধকার সময় ছিল। আমি জানতাম না ভালো সময় কবে আসবে।

‘আমরা ভেতরে যা অর্জন করি, তা বাইরের বাস্তবতাকে বদলে দেয়।’
গ্রিক দার্শনিক প্লুটার্ক

আজ আমি ব্যর্থতার উপকারিতা নিয়ে বলব। কারণ, এটা আমাকে শিখিয়েছে সত্যিটা কী। নিজের সব শক্তি লেখালেখিতে খরচ করা শুরু করি। যদি অন্য কোনো কাজে সফল হতাম, হয়তো সাহস পেতাম না লেখায় সময় দিতে। আমার সবচেয়ে বড় ভয় তখন বাস্তব হয়ে ধরা দেয়। তবু আমি বেঁচে ছিলাম। জীবনের অবলম্বন বলতে ছিল একমাত্র মেয়ে, পুরোনো একটা টাইপরাইটার, আর এক বিশাল গল্প। ব্যর্থতা আমাকে মুক্তি দিয়েছিল। আপনারা হয়তো আমার মতো এত বড় পরিসরের ব্যর্থতার সম্মুখীন হবেন না। তবে জীবনে কিছু না কিছু ব্যর্থতা আসবেই।

যদি আমার কাছে টাইম মেশিন থাকত, তাহলে আমি আমার ২১ বছর বয়সী নিজেকে বলতাম, ব্যক্তিগত সুখ বলতে বোঝায় এমন জীবন, যেখানে তুমি জানো—জীবন মানে শুধু ডিগ্রির সাফল্য নয়। এই ভুলটা অনেক মানুষ করে, বিশেষ করে আমার বয়সী মানুষরা। বাস্তবের জীবন জটিল, কঠিন এবং পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। সেই সত্যটা মানতে পারলে, জীবনের ওঠাপড়া সামাল দেওয়া অনেক সহজ হয়।

কল্পনা হলো এক শক্তি, যা মানুষকে এমন জিনিস ভাবতে শেখায়, যা বাস্তবে নেই, কিন্তু ভাবা যায়। এটা শুধু গল্প লেখার জন্য নয়; এই ক্ষমতার সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো, অন্য মানুষের কষ্ট বুঝতে পারা, যেটা আপনি নিজে কখনো অনুভব করেননি।

আরও পড়ুন

আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি ঘটে ‘হ্যারি পটার’ লেখার আগে। সেই অভিজ্ঞতা পরে যেসব বই লিখেছি, সেগুলোর অনেক কিছুতেই প্রভাব ফেলেছে। যখন বয়স ২০-এর তরুণী, তখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের লন্ডন অফিসে আফ্রিকান রিসার্স বিভাগে কাজ করতাম। কাজের সময় লুকিয়ে গল্প লিখতাম, আর লাঞ্চ ব্রেকে টাইপরাইটারে টাইপ করতাম। অফিসে আমার মূল কাজ ছিল—আফ্রিকার স্বৈরাচারী শাসকদের দেশ থেকে লুকিয়ে পাঠানো চিঠি পড়া। যেখানে বন্দীরা জানাতেন কীভাবে তাঁদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে।

আমি ছবি দেখতাম—হারিয়ে যাওয়া মানুষদের, নির্যাতনের শিকার মানুষদের ক্ষতবিক্ষত শরীরের ছবি। শুনতাম সাক্ষ্য, কীভাবে এক কাউন্টডাউন ট্রায়ালে কাউকে গুলি করে মারা হয়েছে বা কীভাবে পরিবারসহ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই নিজের দেশ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। কেউ কেউ রাজবন্দী ছিলেন, কেউবা রাজনৈতিক কারণে দেশছাড়া। অফিসে এমন অনেকেই নিজের প্রিয়জনের খোঁজে আসতেন—যাঁরা হয়তো আর জীবিত নেই। প্রতিদিনই দেখতাম মানুষ মানুষকে কী ভয়ংকরভাবে নির্যাতন করে শুধু ক্ষমতার জন্য। আমি স্বপ্নে এসব দৃশ্য দেখতে পেতাম—ভীতিকর স্বপ্ন, যেগুলো বাস্তব কাহিনির চেয়েও বেশি ভয়ানক।

‘জীবন আর গল্প একই: কত লম্বা তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কতটা ভালো তা-ই আসল।’
রোমান দার্শনিক সেনেকা

অ্যামনেস্টিতে কাজ করে মানবতার অনেক ভালো দিকও দেখেছি। হাজার হাজার মানুষ, যাঁরা নিজেরা কোনো দিন বন্দী হননি, তাঁরা চিঠি লেখেন, প্রতিবাদ করেন, নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়ান। এই মানবিক সহানুভূতি ও কল্পনার শক্তি মিলেই মানুষের জীবন বাঁচায়। আমি এর ছোট্ট একটা অংশ হতে পেরে গর্ব অনুভব করি।

মানুষই একমাত্র প্রাণী, যারা নিজের অভিজ্ঞতা ছাড়াও অন্যকে বুঝতে পারে, চিন্তা করতে পারে। ঠিক যেন গল্পের জাদুর মতো। এই শক্তিকে ভালো কাজে লাগানো যায়, আবার খারাপ কাজেও। অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে কল্পনা করতে চান না। তাঁরা নিজের জীবন ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবতে চান না। চোখ বন্ধ করে রাখেন, চিৎকার শোনেন না, কষ্ট দেখতে চান না। কিন্তু তাঁদের ভেতরে একধরনের ভয় লুকিয়ে থাকে, আর সেই ভয় আরও বড় হয়। যাঁরা সহানুভূতি দেখাতে অস্বীকার করেন, তাঁরা হয়তো নিজেরা কিছু খারাপ করেন না। কিন্তু নীরব থাকার মাধ্যমে অপশক্তির সহায়ক হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটা কথা শিখেছিলাম। গ্রিক দার্শনিক প্লুটার্ক বলেছিলেন, ‘আমরা ভেতরে যা অর্জন করি, তা বাইরের বাস্তবতাকে বদলে দেয়।’ এ কথার সত্যতা আমরা প্রতিদিন দেখতে পাই। আমাদের অস্তিত্বই অন্য মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে।

তাই বলব, তোমাদের বুদ্ধিমত্তা, কঠোর পরিশ্রমের ক্ষমতা এবং অর্জিত শিক্ষাই তোমাদের আজকের অবস্থানে এনেছে। তোমরা যা করো—ভোট দেওয়া, জীবনযাপন, প্রতিবাদ, তা বিশ্বের অনেক জায়গায় প্রভাব ফেলে। এই প্রভাব একই সঙ্গে এক বিশাল সুযোগ, আবার এক বিশাল দায়িত্ব। তোমরা যদি কেবল প্রভাবশালীদের সঙ্গে না থেকে, দুর্বলদের পক্ষে দাঁড়াও; শুধু নিজের সুবিধা না ভেবে, বঞ্চিতদের কথা ভাবো; কল্পনার সাহায্যে নিজেদের এমন মানুষের জায়গায় কল্পনা করো, যাদের জীবনে তোমাদের সুবিধাগুলো নেই—তাহলে শুধু তোমার পরিবার নয়, হাজারো মানুষ তোমার অস্তিত্বের জন্য কৃতজ্ঞ থাকবে। আমাদের এই পৃথিবী বদলাতে জাদুর দরকার নেই। আমাদের ভেতরেই রয়েছে সেই শক্তি—কল্পনা করার ক্ষমতা। এই কল্পনার শক্তি দিয়ে আমরা আরও ভালো ভবিষ্যৎ ভাবতে পারি, গড়তে পারি।

শেষে তোমাদের মনে করিয়ে দিতে চাই রোমান দার্শনিক সেনেকার কথাটি, ‘জীবন আর গল্প একই: কত লম্বা তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কতটা ভালো তা-ই আসল।’