সাক্ষাৎকার
শব্দের সুরে জীবনের কথা বলেন তিনি
কাগজে–কলমে রইস উদ্দিন হলেও এই গীতিকবি সমাদৃত রইস মনরম নামেই। হাওরপারের মানুষ তাঁকে রইস স্যার বলেই ডাকে। তাঁর অপ্রকাশিত গানের সংখ্যা ৩ হাজারেরও বেশি। তাঁর প্রকাশিত নাটিকা ‘ফুল ফোটার পালা’, ‘ঘোলা জলে বেহুলা’ ও ‘সুজন শোভার পালা’ ছাড়াও অনেক অপ্রকাশিত নাটিকা রয়েছে। ছড়া, কবিতা, নাটক ও বেশ কিছু শিশুতোষ রচনাও লিখেছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে শিক্ষকতা করা এই মানুষটির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ময়মনসিংহ বন্ধুসভার উপদেষ্টা মো. আবুল বাশার। যেখানে উঠে এসেছে নিজের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও জীবন নিয়ে ভাবনার কথা।
বন্ধুসভা: আপনি একজন গীতিকবি, নাট্যকার, ছড়াকার এবং শিক্ষক। কোন পরিচয়টা আপনাকে সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি দেয়?
রইস মনরম: সবার আগে নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ ভাবি। গানের মাধ্যমে আনন্দ ও অনুভূতি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারাটা উপভোগ করি। গীতিকবির পরিচয়ে আনন্দিত হই। তবে আমাকে সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি দেয় শিক্ষকতা। কারণ, এর মাধ্যমে তরুণদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারি।
বন্ধুসভা: শুনেছি, আপনি প্রায় ৩ হাজারের অধিক লোকগান লিখেছেন?
রইস মনরম: হ্যাঁ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যাটা নিজেই টের পাইনি। আমার গানগুলো বেশির ভাগই মাটির গন্ধ মাখা—প্রেম, বিচ্ছেদ, কৃষকজীবন, নদী, মরিচা ধরা সমাজ— সবকিছুই উঠে এসেছে সেখানে। লোকগান আমার রক্তে, আমার আত্মায়।
বন্ধুসভা: সাংস্কৃতিক আবেশে আপনার শুরু কীভাবে?
রইস মনরম: মফস্সল এলাকায় বেড়ে উঠেছি। একবার পূর্ণিমা রাতে বাড়ির সামনে চাঁদের বিশালতা অবলোকন করে প্রথম দুটি লাইন লিখেছিলাম—
‘পুব আকাশে চাঁদ উঠেছে মুখে নিয়ে হাসি
চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আলো রাশি রাশি।’
তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। পরবর্তী সময়ে এটিকে ১৬ লাইনের কবিতায় উন্নীত করি।
বন্ধুসভা: আপনার গান মানুষ কেন পছন্দ করে বলে আপনি মনে করেন?
রইস মনরম: সব সময় চেষ্টা করি মানুষের ভাষায় কথা বলতে। যেভাবে মাঠের কৃষক, পাড়ার নাপিত বা হাটের ভিক্ষুক কথা বলে—তাঁদের ভাষা, তাঁদের কষ্ট, তাঁদের হাসিই আমার শব্দ। তাই গানগুলো সহজ হয়, কিন্তু তার ভেতরটা খুব কাছের হয়ে ওঠে।
বন্ধুসভা: সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ‘লিচুরও বাগানে’ গানের লেখক ছত্তার পাগলার সঙ্গে আপনার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
রইস মনরম: ছত্তার পাগলা আমার একজন প্রিয় লেখক। তিনি আমার বন্ধু। তিনি লোকশিল্পের বিরল আবিষ্কার। তিনি অতুলনীয়। তাঁর সবকিছুর মধ্যেই একদম নিজস্বতা ছিল। তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্ট, জীবন–জীবিকা এবং বাস্তব বিষয়ে নিজস্বতায় লিখতেন। শেষ জীবনের সব পাণ্ডুলিপি আমার কাছে জমা রেখে গেছেন।
বন্ধুসভা: নাট্যকার ও ছড়াকারের কাজের কথাও একটু বলুন।
রইস মনরম: হ্যাঁ, আমি নাটক লিখেছি গ্রামবাংলার বাস্তবতা নিয়ে। আর ছড়ায় শিশুদের জগৎকে তুলে ধরতে ভালোবাসি—যেখানে কল্পনা আর জীবন একসঙ্গে চলে।
বন্ধুসভা: আগামী প্রজন্মকে কী বলতে চান?
রইস মনরম: নিজের শিকড় ভুলে গেলে মানুষ ভেসে যায়। আমি চাই নতুন প্রজন্ম লোকজ সংস্কৃতিকে ভালোবাসুক, গান লিখুক, নাটক করুক—তবে নিজেদের মতো করে, নতুন গন্ধে।
বন্ধুসভা: জীবন নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?
রইস মনরম: মৃত্যু একদিন আসবে, সেটাই চিরসত্য। তাই আমি চাই, আমার কাজগুলো যেন বেঁচে থাকে মানুষের মনে। আমার গান, নাটক, ছড়া—সব যেন জীবনের কথা বলে যায়। আমি চাই, কোনো এক সন্ধ্যায় কেউ হয়তো নদীর ঘাটে বসে আমার লেখা গান গাইবে, কেউ হয়তো স্কুলে আমার লেখা ছড়া পড়ে হাসবে—এইটুকুই প্রাপ্তি। আমি চাই না, সবাই আমার নাম মনে রাখুক, বরং চাই আমার সৃষ্টিগুলো বেঁচে থাকুক মানুষের হৃদয়ে, মানুষের মুখে। যদি আমার কোনো একটি গানও কারও মনে আশা জাগাতে পারে, সমাজকে চিন্তা করতে শেখায়—সেটাই আমার মৃত্যুর পরের সবচেয়ে বড় আনন্দ হবে। আমি মাটির সন্তান। ফিরে যাব মাটিতে। তবে চাই, মাটির গান হয়ে, মানুষের মুখে মুখে বেঁচে থাকতে।