ক্লাব ফুটবল ইতিহাসের আলোচিত সব দলবদল
শেষ হয়েছে ক্লাব ফুটবলের ২০২৫-২৬ মৌসুমের দলবদল। লিভারপুলের বিপুল অর্থ ব্যয় এরই মধ্যে আলোচনায়। তারা খেলোয়াড় কেনাবেচায় এই গ্রীষ্মে ব্যয় করেছে ৪৪৬ মিলিয়ন পাউন্ড (৫৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার), যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭২ হাজার ৮৯৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
মাঝেমধ্যে কিছু কিছু ক্লাব খেলোয়াড় কেনাবেচায় এত বেশি অর্থ ব্যয় করে যে তা আলোচনার জন্ম দেয়। এবারের মৌসুমে রেড ডেভিলদের ট্রান্সফার উইন্ডো এমনই। অনেকেই তাদের এই উইন্ডোকে সর্বকালের সেরা এক ট্রান্সফার মৌসুম বলছেন! আসলেই কি তা–ই?
চলুন দেখা নেওয়া যাক ইতিহাসের আলোচিত কয়েকটি ট্রান্সফার উইন্ডো।
৯. চেলসি (২০০৩)
২০০০ সালের শুরুর দিকেই শুরু হয়েছিল এক মৌসুমে একাধিক খেলোয়াড়ের পেছনে বিপুল অঙ্ক খরচ করার ধারা। সেই ধারার অগ্রভাগে ছিল চেলসি, বিশেষ করে ২০০৩ সালের জুলাইয়ে রুশ-ইসরায়েলি ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচের মালিকানা নেওয়ার পর।
২০০৪ সালের গ্রীষ্মকালীন উইন্ডো বেশি আলোচিত হয়। সে সময় দিদিয়ের দ্রগবা, পেত্র চেখ, রিকার্দো কারভালহো ও আরিয়েন রোবেনের মতো তারকারা যোগ দিয়েছিলেন। তবে আব্রামোভিচ যুগের প্রথম মৌসুম, অর্থাৎ ২০০৩ সালেই মূল ভিত গড়ে ওঠে। সেই সময়ে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে যোগ দিয়েছিলেন ১৪ জন নতুন খেলোয়াড়। যাঁদের মধ্যে ছিলেন হারনান ক্রেসপো, জো কোল, হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন এবং ক্লদ মাকেলেলে। সব মিলিয়ে খরচ হয়েছিল ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি।
৮. ম্যানচেস্টার সিটি (২০০৯)
২০০৮ সালে ডেডলাইন ডেতে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে রবিনহোকে দলে টেনে এরই মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে ম্যানচেস্টার সিটি। তবে নতুন মালিক শেখ মানসুরের অধীন সিটি পরের গ্রীষ্মে আরও বড় ঝাঁপ দেয়। একের পর এক চুক্তির ভিড়ে মাত্র চার দিনের ব্যবধানে দুটি দারুণ সাইনিং করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের হতবাক করে দেয়।
প্রথমে তারা অবিশ্বাস্যভাবে কার্লোস তেভেজকে রাজি করায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়ে সিটিতে যোগ দিতে। গুঞ্জন রয়েছে, আর্জেন্টাইন তারকার এজেন্টদের হাত ঘুরিয়ে দিতে নাকি প্রায় ২৫.৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে সিটি। এরপর আর্সেনাল থেকে এম্যানুয়েল আদেবায়োরকে নিয়ে আসে আরও ২৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে।
৭. বার্সেলোনা (২০১৭)
২০১৭ সালের গ্রীষ্মে বার্সেলোনার হাতে ছিল খরচ করার মতো বিপুল অর্থ। আর সেই অর্থ তারা দ্রুতই খরচ করে ফেলে। আক্রমণভাগে শক্তি বাড়ানোর খোঁজে কাতালানরা ভেঙে ফেলে নিজেদের ইতিহাসের সব ট্রান্সফার রেকর্ড। বরুসিয়া ডর্টমুন্ড থেকে মাত্র ২০ বছর বয়সী উসমান দেম্বেলেকে আনতে খরচ করে ১৪৮ মিলিয়ন ইউরো (১৩৫.৫ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১৭৩ মিলিয়ন ডলার)।
এ ছাড়া তারা বেশ অযৌক্তিকভাবে অর্থ খরচ করে চীনে খেলা সাবেক টটেনহ্যাম তারকা পাউলিনিয়োকে আনতে, সঙ্গে নেলসন সেমেদো ও জেরার্ড দেলুফেউ। দেম্বেলে ধীরে ধীরে বার্সায় নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করলেও সামগ্রিকভাবে এই উইন্ডোকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বাজে ট্রান্সফার মৌসুম হিসেবেই মনে করা হয়।
৬. আল-হিলাল (২০২৩)
২০২৩ সালের গ্রীষ্মকালীন উইন্ডোতে আল-হিলালের মাধ্যমে হঠাৎ করেই বিশ্ব ট্রান্সফার মার্কেটে আলোচনায় উঠে আসে সৌদি প্রো লিগ। আরব দেশটির সার্বভৌম পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের অর্থায়নে তারা মাত্র এক মৌসুমেই আটজন নতুন খেলোয়াড় কেনায় খরচ করে ৩০২ মিলিয়ন পাউন্ড, যা গোটা ফুটবল বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়।
এই দলবদলের অন্যতম নাম পিএসজি থেকে নেইমারের আগমন। তাঁকে দলে ভেড়াতে ৯০ মিলিয়ন ইউরো (৭৭ মিলিয়ন পাউন্ড/৯৯ মিলিয়ন ডলার) খরচ করে আল-হিলাল। তাঁর সঙ্গে দলে যোগ দেন রুবেন নেভেস, সের্গেই মিলিনকোভিচ-সাভিচ এবং ম্যালকমসহ আরও অনেক বড় নাম।
৫. চেলসি (২০২৩–গ্রীষ্মকাল)
নতুন মালিকানায় আসার পর থেকেই চেলসি একের পর এক অযৌক্তিক ব্যয়ের নজির গড়ছিল। তবে ২০২৩ সালের গ্রীষ্মকালীন উইন্ডোতে তাদের কার্যক্রম এমন ছিল যে ফুটবল দুনিয়া অবাক হয়ে যায়। কেউ কেউ রীতিমতো বিরক্তি প্রকাশ করে। ব্লুজরা এক মৌসুমেই ১২ জন নতুন খেলোয়াড়কে দলে ভিড়িয়ে প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ের রেকর্ড গড়ে।
এই বিপুল অর্থের এক-চতুর্থাংশ খরচ করে মোইসেস কাইসেডোর পেছনে। অবিশ্বাস্যভাবে চেলসি তাঁকে রাজি করায় লিভারপুলের বদলে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে আসতে। কয়েক দিনের মধ্যেই চেলসি আবার লিভারপুলের ব্যাকআপ টার্গেট রোমিও লাভিয়াকেও সাউদাম্পটন থেকে টেনে আনে ৫৮ মিলিয়ন পাউন্ড (৭৪ মিলিয়ন ডলার) খরচ করে। অন্যদিকে প্রায় অপরিচিত কোল পালমারও ম্যান সিটি থেকে একেবারে ডেডলাইন ডেতে দলে যোগ দেন। তাঁর জন্য ব্যয় করা হয় ৪২ মিলিয়ন পাউন্ড (৫২ মিলিয়ন ডলার)।
৪. পিএসজি (২০২১)
সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ট্রান্সফার উইন্ডোগুলোর একটি ২০২১ সালের পিএসজির দলবদল। বার্সেলোনার আর্থিক সংকটে বাধ্য হয়ে ক্যাম্প ন্যু ছেড়ে যাওয়া লিওনেল মেসিকে দলে ভেড়ায় তারা। পাশাপাশি রিয়াল মাদ্রিদ থেকে সার্হিও রামোস, লিভারপুল থেকে জর্জিনিও ভেইনালডাম—দুজনকেই ফ্রি এজেন্ট হিসেবে। এ ছাড়া একই মৌসুমে দলে ভেড়ায় আশরাফ হাকিমি, নুনো মেন্ডেস ও জিয়ানলুইজি ডোনারুম্মাকে। যাঁদের মধ্যে প্রথম দুজন এখন দলের অপরিহার্য সদস্য, আর ডোনারুম্মা সম্প্রতি ম্যান সিটিতে যোগ দিয়েছেন।
৩. রিয়াল মাদ্রিদ (২০০৯)
ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে রিয়াল মাদ্রিদ আবারও শুরু করে ‘গ্যালাক্টিকোস’ যুগের পুনর্গঠন। ২০০৯ সালের গ্রীষ্মকালীন উইন্ডো নিঃসন্দেহে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং সফল ট্রান্সফার মৌসুমগুলোর একটি। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে তারা দুবার ভাঙে বিশ্ব ট্রান্সফার রেকর্ড এবং দলে ভেড়ায় বিশ্বের দুই সেরা খেলোয়াড়কে।
প্রথমে এসি মিলানের সুপারস্টার কাকার চুক্তি—৫৬ মিলিয়ন পাউন্ডে। কয়েক দিনের মধ্যেই সেটিকে ছাপিয়ে যায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে ৮০ মিলিয়ন পাউন্ড (১৩১ মিলিয়ন ডলার) দিয়ে বার্নাব্যুতে নিয়ে আসার মাধ্যমে।
একই উইন্ডোতে লিওঁ থেকে তরুণ স্ট্রাইকার করিম বেনজেমা, লিভারপুল থেকে মিডফিল্ডার জাবি আলোনসো আর ভ্যালেন্সিয়া থেকে সেন্টারব্যাক রাউল আলবিওলকেও দলে ভেড়ায় ক্লাবটি।
২. লিভারপুল (২০২৫)
ভবিষ্যতে ইতিহাস কীভাবে বিচার করবে, সেটা এখনই বলা কঠিন, তবে কাগজে-কলমে লিভারপুলের ২০২৫ সালের গ্রীষ্মকালীন দলবদল নিঃসন্দেহে অবিশ্বাস্য!
মে মাস শেষ হওয়ার আগেই রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমানো ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ডের বিকল্প খুঁজে নেয় তারা—দলে ভেড়ায় জেরেমি ফ্রিমপংকে। এরপরই ব্রিটিশ ট্রান্সফার রেকর্ড ভেঙে বায়ার্ন লেভারকুসেনের ফ্লোরিয়ান ভির্টজকে ১১৬ মিলিয়ন পাউন্ডে (১৫৪ মিলিয়ন ডলার) দলে টানে। কিছুদিন পরেই ফুলব্যাক শক্তিশালী করতে বোর্নমাউথ থেকে মিলোস কেরকেজকে আনা হয়।
জুলাইয়ে নিউক্যাসল স্ট্রাইকার আলেকজান্ডার ইসাকের পেছনে ছোটা শুরু করলেও এরই ফাঁকে আক্রমণভাগে নতুন সংযোজন হুগো একিতিকে ৭৯ মিলিয়ন পাউন্ডে (১০৬ মিলিয়ন ডলার) কিনে লিভারপুর। পারমা থেকে প্রতিভাবান তরুণ সেন্টারব্যাক জিওভান্নি লেয়োনিকেও দলে টানা হয়। সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্ত আসে ডেডলাইন ডেতে। দীর্ঘ টানাপোড়েন শেষে ইসাককে আনা হয় একেবারে রেকর্ডভাঙা চুক্তিতে—১২৫ মিলিয়ন পাউন্ডে (১৬৯ মিলিয়ন ডলার)। এতে দ্বিতীয়বারের মতো ব্রিটিশ ট্রান্সফার রেকর্ড ভাঙল রেডসরা।
সব মিলিয়ে লিভারপুলের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪৪৬ মিলিয়ন পাউন্ড (৫৯৭ মিলিয়ন ডলার), যা এক মৌসুমে কোনো প্রিমিয়ার লিগ ক্লাবের সর্বকালের সর্বোচ্চ খরচ।
১. পিএসজি (২০১৭)
আট বছর আগে পিএসজির চমকপ্রদ দলবদল এখনো ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় হিসেবে পরিচিত, যা ক্লাবটির বৈশ্বিক ব্র্যান্ড বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। বার্সেলোনার সুপারস্টার নেইমারকে ২২২ মিলিয়ন ইউরো (২০০ মিলিয়ন পাউন্ড বা ২৬২ মিলিয়ন ডলার) দিয়ে দলে টানে তারা, যা এখন পর্যন্ত ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ট্রান্সফার হিসেবে রেকর্ড ধরে রেখেছে।
তবে কাতারি মালিকানাধীন ক্লাবটি এখানেই থেমে থাকেনি। তারা ১৮ বছর বয়সী প্রতিভাবান কিলিয়ান এমবাপ্পেকে মোনাকো থেকে ধারে নিয়ে আসে। পরে এক বছরের মধ্যেই ১৮০ মিলিয়ন ইউরো (১৬৬ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১৯৫ মিলিয়ন ডলার) খরচ করে তাঁকে কিনে নেয়।
সূত্র: গোলডটকম