ফুটবল
মায়ের ফোন কল বদলে দিল সবকিছু
লিভারপুল ও আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার। বিশ্বকাপ জেতার দুই বছর আগেও যিনি ক্লাব ফুটবলে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেতেন না। ধীরে ধীরে সবকিছু স্বপ্নের মতো বদলে যায়। দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে শুনিয়েছেন নিজের জীবনের গল্প। সেটিরই কিছু অংশ পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হলো।
সবার আগে মাকে জড়িয়ে ধরতে চাই। তিনি ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব হতো না—প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে পারতাম না, বিশ্বকাপ জয় করতে পারতাম না, হয়তো কেউ আমার নামও জানত না।
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। ভিডিও কলে মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম, আর কাঁদছিলাম। তখন ইংল্যান্ডের ব্রাইটনে একটি ফ্ল্যাটে আমি একা, মা ছিলেন আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে। আমি পুরো হতাশ। মাকে বলেছিলাম, ‘আর পারছি না। দেশে ফিরে আসতে চাই।’
সে সময় ব্রাইটনের হয়ে খুব কম সময়ই খেলতে পারছিলাম। বিষয়টা লজ্জাজনক ছিল। কারণ, প্রিমিয়ার লিগের একটা ক্লাবের ১০ নম্বর জার্সি পরতাম, যা আর্জেন্টিনার অসংখ্য ছেলের স্বপ্ন, অথচ আমি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। নিজেকে অভিশপ্ত মনে হতো।
ওই বছরের শুরুতে বোকা জুনিয়র্স থেকে ইংল্যান্ডে এলাম। প্রথম ম্যাচে বদলি হিসেবে নেমেছিলাম। কয়েক দিন পরেই করোনা মহামারির কারণে পুরো বিশ্ব থমকে গেল। সব বন্ধ। কোনো ফুটবল নেই। কোনো বন্ধু নেই। সবচেয়ে খারাপ লাগার ব্যাপার হলো, আমি আটকে গেলাম এমন একটি দেশে, যেখানের ভাষা জানতাম না।
প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতাম। জিজ্ঞেস করতাম ওভেন কীভাবে চালু করতে হয়, ডিটারজেন্ট কোথায় রাখতে হয়। আর একা থাকা, খেলতে না পারা—সব মিলিয়ে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছিলাম। সেবার ক্রিসমাসে স্টেডিয়ামে কোনো দর্শক ছিল না। আমার ব্যাগ গোছানো ছিল। আমার কাছে দুটি অফার ছিল—একটা রাশিয়া, আরেকটা স্পেন থেকে। মনকে বুঝিয়ে ফেলেছিলাম চলে যাব। তারপর মায়ের ফোন। ওনারা সব সময় জানেন, কী বলতে হবে! আপনি যতই বড় হোন না কেন, মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় আবার ছোট্ট বাচ্চা হয়ে যাবেন।
যখন ছোট ছিলাম, শিক্ষকেরা যখন জিজ্ঞেস করতেন বড় হয়ে কী হতে চাই, আমি বলতাম—ফুটবলার। অনেকেই ভাবে আমার বাবা বোকা জুনিয়র্স ক্লাবের কিংবদন্তি হওয়ায় সন্তানেরও একই স্বপ্ন। তবে সত্যিটা হলো, বাবা যদি একজন প্লাম্বারও হতেন, তখনো বলতাম ফুটবলার হব। এখনো মনে আছে, প্রথমবার যেদিন বাবা আমাদের ভাইদের খেলা দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন। গ্যালারির আসন পর্যন্ত যেতে আমাদের প্রায় এক ঘণ্টা লেগেছিল। কেউ বাবার সঙ্গে ছবি তুলতে চাইছে, কেউ অটোগ্রাফ চাইছে, কেউ শুধু কথা বলতে চাইছে। সেখান থেকেই শুরু ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। বুঝতে শুরু করলাম ফুটবলার বাবা আসলে কেমন, কীভাবে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন।
ব্রাইটনের হয়ে বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে ওই সময়গুলোর কথা মনে পড়ত। আমি শুধু দেশে ফিরতে চাইতাম। তখন মা অনুপ্রেরণা দিতেন। বলতেন, ‘মনে আছে তুমি কত চেয়েছিলে এটা (ফুটবলার হতে)? তোমাকে সাহসী হতে হবে। হাল ছাড়া যাবে না।’
একবার ভাবুন তো, যদি স্পেনে চলে যেতাম? বা রাশিয়ায়? আজ আমি হয়তো শুধু কোনো কুইজ প্রতিযোগিতার একটা প্রশ্ন হয়ে থাকতাম। প্রশ্নটা এমন—‘আর্জেন্টিনার সেই ছেলেটা কে, যাঁর আইরিশ নাম ছিল, যে ব্রাইটনের হয়ে ১৫টা ম্যাচ খেলেছিল?’
কিন্তু না, সেটা আমার নিয়তি ছিল না।
২০২০ সালের ক্রিসমাসের পর ব্রাইটনে একের পর এক খেলোয়াড়ের ইনজুরি। তখন আমাকে মাঠে না নামানো ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তারপর থেকে ধীরে ধীরে নিয়মিত ম্যাচ খেলার সুযোগ পেতে থাকি। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে যখন এভারটনের বিপক্ষে দুই গোল করলাম, মনে হয়েছিল আমার ভালো সময়ের শুরু হলো। সবকিছু যেন হঠাৎ করে আমার পক্ষে এসে গেঁথে গেল। মনে পড়ল ছোটবেলায় বাবার বলা একটা গল্প।
তিনি যখন প্রথম বোকা জুনিয়র্সে খেলতে শুরু করেন, কিছুতেই ভালো খেলতে পারছিলেন না। ভালো খেলার সব ধরনের চেষ্টাই করছিলেন। শেষে মাথায় এল এক আইডিয়া—বুটে লম্বা স্টাড লাগালেন। তারপর থেকে তিনি ভালো খেলতে শুরু করলেন। ওই বুটটাই তাঁর পুরো মানসিকতা পাল্টে দিয়েছিল। যদিও এর কারণ এখনো তিনি বলতে পারেন না। প্রতিটি ফুটবলারের জীবনে এমন একটা মুহূর্ত আসে—একটা ক্লিক। আমার জন্য এভারটনের বিপক্ষে গোল দুটি ছিল সেই ক্লিক।
তখন কাতার বিশ্বকাপের আর মাত্র ১১ মাস বাকি। একদিন বাবা বললেন, ‘যদি প্রিমিয়ার লিগে নিয়মিত খেলে যেতে পারো, তুমি আর্জেন্টিনা দলে জায়গা পাবে।’ জবাবে বলেছিলাম, ‘বাবা, তুমি পাগল নাকি। ওরা (আর্জেন্টিনা) একেবারে গোছানো একটা দল। মাত্রই কোপা আমেরিকা জিতেছে। নতুন করে আমার মতো কাউকে দলে নেবে, এটা অসম্ভব।’ বাবা বললেন, ‘আমি বলছি তো।’
বিশ্বকাপের কয়েক মাস আগে ডি জার্বি যখন ব্রাইটনের ম্যানেজার হয়ে এলেন, তখন আমার জীবনে সবকিছু বদলে গেল। তিনি যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি শিখিয়েছেন, তা হলো মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে পারা। প্রতি সেকেন্ডে দাবার বোর্ডের মতো মাঠের পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। সেটি শেখার পর আমার খেলা একেবারেই ভিন্নমাত্রায় পৌঁছে যায়। প্রতি ম্যাচে খেলছি, ম্যানেজারও আস্থা রাখছেন।
উলভারহ্যাম্পটনে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলাম। হোটেলে থাকাকালে জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ফোনকলটি পেলাম। সেই মুহূর্তটি কখনোই ভুলব না। বাবার কথাই সত্যি হলো! আমি আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ দলে আছি। সত্যিই কাতারে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মাকে ভিডিও কল করলাম, সবাই আনন্দে কেঁদে ফেললাম।
যেই আমি দুই বছর আগে ম্যাচের পর ম্যাচ ব্রাইটনের বেঞ্চে বসে কাটাচ্ছিলাম, সেই আমি এখন আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপে যাচ্ছি, ইতিহাস গড়তে।
সৌভাগ্যক্রমে, আর্জেন্টাইন হিসেবে আমরা জানি কীভাবে কষ্টের কথা ভুলতে হয়। এটা আমাদের ডিএনএতে। ফুটবল ম্যাচ ৯০ মিনিটের। আপনি যদি ৮০ মিনিট নিখুঁত খেলেন, কিন্তু শেষ ১০ মিনিট খেলতে পারলেন না; তাহলে কোনো দিনই চ্যাম্পিয়ন হতে পারবেন না। দেশ হিসেবে, এটাই আমাদের শক্তি। আমরা এই উন্মাদনা একটু উপভোগও করি।
কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ডাচদের বিপক্ষে মুহূর্তটাই দেখুন—সবকিছু পাগলামিতে পরিণত হলো, সবাই লড়াই শুরু করল। সেই মুহূর্তটাই টুর্নামেন্টের বাকি সময়টার জন্য আমাদের ছন্দ ঠিক করে দিয়েছিল। আমরা ভয়হীন হয়ে খেলতে শুরু করি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ছোটবেলা থেকেই আমি ম্যাচের আগে সব সময় নার্ভাস হতাম। কিন্তু বিশ্বকাপের পুরো সময়টায় একটুও নার্ভাস হইনি। এমনকি ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষেও না।
অনেক দেশই ফুটবলকে ভালোবাসে। কিন্তু আর্জেন্টিনার জন্য এটা আধ্যাত্মিক কিছু। ফাইনালের অতিরিক্ত সময়ে, এমি মার্টিনেজ আমাদের সবাইকে বাঁচাল, পুরো দেশকে বাঁচাল। ম্যাচের ১২২ মিনিটের সময় আমি বদলি হয়ে উঠে যাই। স্কোরলাইন ৩–৩, ম্যাচ যাচ্ছিল টাইব্রেকারের দিকে। বেঞ্চে সবাই একদম চুপচাপ, বাঁশির অপেক্ষায়। পুরো স্টেডিয়াম নীরব। অদ্ভুত এক পরিবেশ। হঠাৎ করেই যেন পৃথিবী থমকে গেল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সম্ভবত কেউ শ্বাসও নেয়নি!
আমি শুধু দেখছিলাম, নীল জার্সি পরা একজন খেলোয়াড় ডিবুর (এমি মার্টিনেজ) সামনে দাঁড়িয়ে, পায়ের কাছে বল। চারপাশে কেউ নেই। জীবনে এতটা অসহায় আর কখনো অনুভব করিনি। আমি ভেবেছিলাম, শেষ। আমরা বিশ্বকাপ হেরে গেছি।
কিন্তু আর্জেন্টিনায় গোলকিপার নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে—‘গোলকিপার হতে হলে, হয় তোমাকে পাগল হতে হবে, নয়তো বোকা।’ আমাদের কাছে ডিবু হলো পাগলটা! ওর ভেতরে শিশুসুলভ একটা আত্মা আছে। সে এমন সবকিছু করে, যা কেবল একটা বাচ্চাই ভাবতে পারে। কারণ সে মুহূর্তটায় বাঁচে, খেলার ভেতরেই খেলে।
তারপর আমরা বিমানে চড়ে দেশে ফিরলাম। বুয়েনস এইরেসে নেমে দেখি রাস্তায় ৫০ লাখ মানুষ! জীবনের সবচেয়ে বড় স্মৃতি এটাই। আমরা কেউই তখনো বুঝতে পারছিলাম না কী অর্জন করেছি। মাইলের পর মাইল ধরে মানুষ আমাদের বাসের পাশে দৌড়াচ্ছিল। বয়স্ক মানুষেরা অশ্রু নিয়ে কৃতজ্ঞতার স্বরে বলছিল, ‘আমরা ৩৬ বছর ধরে এ মুহূর্তের অপেক্ষা করেছি।’
শেষ পর্যন্ত হেলিকপ্টারে আমাদের বের করে আনতে হয়েছিল। এতটাই পাগল করা পরিবেশ! আমরা ৫০ লাখ মানুষের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলাম, বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে।
কয়েক দিন পরই আবার ব্রাইটনে ফিরে গেলাম। জানুয়ারির মাঝামাঝি ইংল্যান্ড! ভীষণ ঠান্ডা! বৃষ্টি! বুঝতেই পারিনি জীবন কতটা বদলে গেছে।
সেই মৌসুমের শেষে, ইয়ুর্গেন ক্লপ (লিভারপুলের তৎকালীন কোচ) আমাকে দেখতে এলেন। ব্যাপারটা যেন জেমস বন্ড সিনেমার মতো। তিনি উড়ে এলেন, আর আমরা গোপনে দেখা করলাম ব্রাইটনের মাঝামাঝি একটি জায়গায়। বেশ অবাক হয়েছিলাম। হ্যাঁ, আমি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন, কিন্তু কোনো তারকা খেলোয়াড় নই। আমরা কফি খেলাম, তিনি সত্যিই চান আমি লিভারপুলে যাই।
ফুটবল আর জীবন একই। খুবই অপ্রত্যাশিত। কখনো আপনি খারাপ খেলবেন, কিন্তু জানেন না কেন। আমার গল্প দেখুন। ২০২০ সালে আমি কিছুই ছিলাম না। ব্রাইটনের হয়ে একটি ম্যাচেও সুযোগ পাচ্ছিলাম না। মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কান্না করতাম, আর বাড়ি ফিরতে চাইতাম।
দুই বছর পর, আমি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এরপর কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন। এখন প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন। এমনকি ব্যালন ডি’অর মনোনয়ন তালিকাতেও রয়েছি।