ওয়েস্টমিথের হৃদয়ে মৌটের টুর আর্ড আর্টস সেন্টার
বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে বসবাস করছেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক অর্থ সম্পাদক সজল মিত্র রিচার্ড। ঘুরে দেখছেন দেশটির দর্শনীয় সব স্থান। সেসব নিয়ে বন্ধুসভার পাঠকদের জন্য লিখেছেন তিনি। আইরিশ নৈসর্গিক রূপকথার ধারাবাহিক পর্বের সপ্তম গল্পে থাকছে আয়ারল্যান্ডের ওয়েস্টমিথ কাউন্টিতে অবস্থিত টুর আর্ড আর্টস সেন্টারের কথা।
কঠিন পাথর-কংক্রিটের মধ্যেও থাকে ইতিহাস-ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্যের ভাঁজে মুখ লুকিয়ে খেলা করে অনাবিল সৌন্দর্য। পাথরের নীরবতায় আচ্ছন্ন পৃথিবীতে ব্যক্ত করা যায় না দেয়ালের অনুভূতি। তবু সেই নিষ্প্রাণ দেয়ালের অব্যক্ত কথাগুলো তার অবয়বে ফুটে ওঠে সীমাহীন মোহনীয়তায়। বলা হচ্ছে আয়ারল্যান্ডের ওয়েস্টমিথ কাউন্টির টুর আর্ড আর্টস সেন্টারের কথা।
ইতিহাসের ইটের ভাঁজে শিল্পের আলো
আয়ারল্যান্ডের সবুজ শ্যামলিমায় মোড়ানো ওয়েস্টমিথ কাউন্টি। চারপাশে লেক, বন আর খোলা প্রান্তর—তার মাঝেই ছোট্ট, শান্তশিষ্ট শহর মৌট। নামের মতোই যেন এক মায়াবী আস্তানা। এ শহরের বুকেই দাঁড়িয়ে আছে টুর আর্ড আর্টস সেন্টার, যা কেবল একটি সাংস্কৃতিক ভবন নয়, বরং অতীতের ইতিহাস আর বর্তমানের সৃজনশীলতার মিলনমেলা।
ভবনটির বয়স প্রায় আড়াই শতাব্দী। ১৭৭০ সালের দিকে যখন পেনাল আইনের শিকল আয়ারল্যান্ডের গ্রামীণ জীবনে কঠোরভাবে আঁকড়ে ছিল, তখন এখানেই তৈরি হয়েছিল এক ক্ষুদ্র ক্যাথলিক চ্যাপেল। সেদিনের মানুষ গোপনে প্রার্থনা করতে আসত এই প্রাঙ্গণে। সময়ের স্রোতে চ্যাপেল রূপ নিল জাতীয় বিদ্যালয়ে; ১৮৭১ সালে জন্ম হলো মৌট ন্যাশনাল স্কুলের। উনিশ শতকের শেষভাগে কিশোর ছাত্রদের পাঠশালার কোলাহলে মুখর হয়ে উঠেছিল দেয়ালগুলো।
পরবর্তী সময়ে, ১৯৩৭ সালে আবারও রূপান্তর। এবার নাম হলো সেন্ট প্যাট্রিক হল, এটি একটি পার্সি সংস্কৃতিচর্চামূলক হল; যা কয়েক দশক ধরে স্থানীয় সমাজজীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এখানে কখনো নাটক, কখনো সামাজিক অনুষ্ঠান, কখনো রাজনৈতিক বৈঠক—সবকিছুরই আয়োজন হয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভবনটি পুরোনো হয়ে পড়ে, অবকাঠামো ভাঙাচোরা হয়ে যায়।
এক নতুন ভোরের সূচনা
১৯৯০–এর দশকে মৌটের মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। ভবনটির ভগ্নদশা দেখে অনেকে ভেবেছিলেন হয়তো একদিন সব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। কিন্তু স্থানীয় মৌট কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো—এই ঐতিহাসিক স্থাপনাকে তারা ফিরিয়ে আনবে নতুন প্রাণে। ছয় বছর ধরে তহবিল সংগ্রহ, পরিকল্পনা, শ্রম আর প্রত্যয়ের ফলেই অবশেষে পুনর্জন্ম পেল ভবনটি।
১৭ অক্টোবর ২০০০—এক স্মরণীয় দিন। আয়ারল্যান্ডের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেরি ম্যাকঅ্যালিস আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করলেন টুর আর্ড আর্টস সেন্টার। পুরোনো ভবনের দেয়ালে নতুন প্রাণ, নতুন নাম, আর নতুন উদ্দেশ্য—শিল্প ও সংস্কৃতিকে মানুষের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে একাত্ম করে তোলা।
স্থাপত্যে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন
টুর আর্ডের ভবনে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়ে ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ছাপ—খিলান জানালা, মোটা দেয়াল আর প্রাচীন নকশার ছায়া। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক নকশার সহজলভ্যতা—প্রশস্ত করিডর, উজ্জ্বল আলো, হুইলচেয়ার-বান্ধব প্রবেশদ্বার।
বাইরে রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা, ভেতরে মসৃণ কাঠের মেঝে আর সাদা দেয়ালের গ্যালারি। যেন ইতিহাসের ভেতরে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের সঙ্গে হাত মেলানো।
শিল্প ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র
টুর আর্ড এক বহুমাত্রিক শিল্পকেন্দ্র। অডিটরিয়াম—১৭৩ আসনের টায়ার্ড সিটিংসহ থিয়েটার অডিটরিয়াম দর্শকদের এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়। আধুনিক লাইটিং ও সাউন্ড সিস্টেমে নাটক, সংগীত, কমেডি বা সিনেমা হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। স্থানীয় স্কুলের বার্ষিক নাটক থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের খ্যাতনামা শিল্পীর কনসার্ট, সবই হয় এখানে।
কনফারেন্স রুম প্রথম তলার উজ্জ্বল ঘর, যেখানে ৩৫ জন পর্যন্ত বসতে পারেন। ব্যবসায়িক মিটিং, প্রশিক্ষণ, কর্মশালা বা ছোট আকারের সেমিনারের জন্য আদর্শ। বব ট্রেনর গ্যালারি সাদা দেয়াল, প্রাকৃতিক আলো আর খিলান–ছাদের অনন্য মিশেল। প্রদর্শনী হলে দাঁড়িয়ে মনে হয় যেন ক্যানভাসগুলো নিজের সঙ্গে কথা বলছে। এখানে নিয়মিত চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্রী ও ভাস্করদের কাজ প্রদর্শিত হয়।
কফিশপ ও রেস্তোরাঁয় দিনভর দর্শনার্থীদের ভিড় জমে এখানে। সদ্য বানানো কেকের গন্ধ, কফির ধোঁয়া আর মানুষের হাসি–আড্ডা মিলেমিশে কেন্দ্রটিকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
ভাস্কর্যে অতীতের প্রতিধ্বনি
সেন্টারের সামনের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্য ‘দ্য বারগেইন’ এক বিশেষ আকর্ষণ। শিল্পী জ্যাকি ম্যাককেন্নার হাতে তৈরি এ কাজটি স্মরণ করায় মৌটের একসময়ের বিশাল গরুর হাটকে। গরুর দড়ি হাতে দুজন মানুষের লেনদেনের মুহূর্ত ধরা পড়েছে এতে। ভাস্কর্যটি যেন নীরবে বলে যায় আমরা ছিলাম, আমরা আছি, আমরা এগিয়েই চলব।
কর্মকাণ্ড ও সৃজনশীলতার বিস্তার
টুর আর্ডের মূল লক্ষ্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্পীদের মিলন ঘটানো। বছরজুড়ে এখানে আয়োজন হয় নানা ধরনের অনুষ্ঠান—
• নাটক ও কমেডি শো: আয়ারল্যান্ডের গ্রামীণ জীবনের হাসি–কান্না, গল্প–উপাখ্যান নাট্যরূপে ধরা দেয়।
• সংগীত কনসার্ট: শাস্ত্রীয় সুর থেকে আধুনিক ব্যান্ডের ঝড়—সবই শোনা যায় এই অডিটরিয়ামে।
• ভিজ্যুয়াল আর্টস প্রদর্শনী: স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্পীরা তাঁদের কাজ গ্যালারিতে তুলে ধরেন। সম্প্রতি দ্য পেয়াটল্যান্ড নামে এক ইমার্সিভ প্রদর্শনী প্রকৃতির টানাপোড়েনের গল্প বলেছে।
• ওয়ার্কশপ ও আউটরিচ প্রোগ্রাম: শিশু, তরুণ, এমনকি প্রবীণদের জন্যও আয়োজন করা হয় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম।
এভাবে টুর আর্ড ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে এক বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক মঞ্চ, যেখানে প্রত্যেকে নিজের মতো করে অংশ নিতে পারেন।
অর্থায়ন ও কমিউনিটির ভূমিকা
টুর আর্ড আসলে এক কমিউনিটি–নেতৃত্বাধীন প্রকল্প। স্থানীয় মানুষের শ্রম, সময় আর প্রত্যয় এর ভিত্তি। পাশাপাশি আয়ারল্যান্ডের গ্রামীণ উন্নয়ন দপ্তর ও বিভিন্ন প্রকল্পের সহায়তায় এটি আর্থিক স্থিতি পেয়েছে। বিশেষ করে লিডার প্রোগ্রাম এবং কমিউনিটি সার্ভিস প্রোগ্রামের অনুদান কেন্দ্রটির উন্নয়ন ও কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সহায়তা করছে।
ভ্রমণকারীর জন্য টুর আর্ড
মৌট শহর ডাবলিন থেকে সহজেই যাওয়া যায় এম-৬ মহাসড়ক ধরে। শহরের কেন্দ্রেই টুর আর্ড। অতএব ভ্রমণকারীর জন্য খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। ফ্রি পার্কিং, পরিবারবান্ধব পরিবেশ আর সর্বজনীন প্রবেশাধিকার, সবই নিশ্চিত।
আপনি চাইলে দিনে কফিশপে বসে কফির কাপে চুমুক দিয়ে স্থানীয় জীবনের স্পন্দন অনুভব করতে পারেন। আবার সন্ধ্যায় নাটক বা কনসার্ট দেখে সময় কাটাতে পারেন। আর যদি শিল্পের প্রেমিক হন, তবে অবশ্যই ঢুঁ মারতে হবে বব ট্রেনর গ্যালারিতে।
শিল্পের আলোয় আলোকিত এক শহর
টুর আর্ড শুধু মৌটের নয়, পুরো ওয়েস্টমিথের গর্ব। এটি প্রমাণ করেছে, ইতিহাসের পুরোনো দেয়াল ভেঙে ফেলার নয়, বরং তাকে নতুন অর্থে সাজিয়ে তোলার মধ্যে ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে। এখানে যেমন আছে অতীতের স্মৃতি, তেমনি আছে বর্তমানের কোলাহল আর আগামী দিনের স্বপ্ন।
যে ভ্রমণপিপাসু একবার টুর আর্ডের দোরগোড়ায় পা রাখবেন, তাঁর কাছে এটি কেবল একটি ভবন হয়ে থাকবে না। বরং হয়ে উঠবে শিল্প–সংস্কৃতির এক অনন্য আশ্রয়, আয়ারল্যান্ডের অন্তর্লীন সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়ার এক উজ্জ্বল দরজা।
অনেক কিছু জানার আগ্রহ নিয়ে ঘুরলাম। জানলাম যতটুকু, ইতিহাস নাকি এর চেয়েও বিশদ। বলতে পারলাম কতখানি সেটি নিশ্চিত নই, তবে এখানকার দীর্ঘ ইতিহাসের অংশবিশেষ স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব হয়েছে। বাকিটা নিজে বাস্তবে গিয়ে ভ্রমণ করেই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। দিনটা কাটল অসাধারণ।
ওয়েস্টমিথ কাউন্টি, আয়ারল্যান্ড